ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে আপনি হয়ত কখনো না কখনো স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম এই শব্দগুলো শুনেছেন। আসলে এই জিনিসটা কী, কীভাবে ব্যবহৃত হয় তা যদি আপনার জানতে ইচ্ছে করে তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্যই।

আমরা এই লেখায় স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম নিয়ে সহজ ভাষায় আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আশাকরি শেষপর্যন্ত পড়লে স্যোশাল মিডিয়া কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেককিছুই বুঝতে পারবেন। চলুন শুরু করি।

স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম

স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম সম্পর্কে জানার আগে অ্যালগরিদম কী জিনিস সেটা সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা প্রয়োজন। অ্যালগরিদম মূলত, কোন কাজ বা সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তার একটি সুনির্দিষ্ট ক্রম একটি নির্দেশনা। যা ধাপে ধাপে বর্ননা করা হয়ে থাকে। কম্পিউটার সায়েন্সে অ্যালগরিদম গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, দৈনন্দিন জীবনেও নানাভাবে নানা সময় আমরা অ্যালগরিদম ব্যবহার করে থাকি।

ধরুন, আপনি চা বানাবেন। এর জন্য আপনাকে প্রথমে চা পাতা, চিনি, পানি গরম করার ব্যবস্থা আছে কিনা সেটা দেখে নিতে হবে। এরপর যদি সবকিছু হাতের নাগালেই থাকে তাহলে, চা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করবেন। না থাকলে সেগুলো জোগাড় করে কাজ চা বানানো শুরু করবেন। এখানেও প্রথমে পানি গরম করতে হবে। এরপর চা পাতা, চিনি দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। সব শেষে, চা ছেঁকে কাপে ঢালতে হবে।

স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম

খুব সামান্য কাজ। কিন্তু এখানেও আপনি অ্যালগরিদম ব্যবহার করেছেন হয়ত আপনার অজান্তেই। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য এই ধাপগুলোর সুবিন্যাস্ত ভাবনাগুলোর সমষ্টিকেই আমরা অ্যালগরিদম বলতে পারি। অ্যালগরিদমের সাহায্য নিয়ে যে কোন কাজ খুব গুছিয়ে, সুন্দরভাবে সমাধান করে ফেলা যায়।

আরও পড়তে পারেনঃ ই-সিম কী? ই-সিম সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার

স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম কী?

আমরা এখানে মূলত স্যোশাল মিডিয়ার নিউজ ফীড অ্যালগরিদম নিয়ে কথা বললো। যে অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ঠিক করা হয়, আপনি আপনার নিউজফীডে কী ধরণের কন্টেন্ট দেখবেন, কী পরিমাণ কন্টেন্ট দেখবেন, কাদের পোস্ট বা ছবি দেখবেন এই বিষয়গুলো। অর্থাৎ একটি স্যোশাল মিডিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে এই অ্যালগরিদম।

কীভাবে কাজ করে এই অ্যালগরিদম?

স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম মূলত মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরী করা হয়ে থাকে। যেটা একজন ব্যবহারকারীর গতিবিধি বিশ্লেষণ করে। এবং এর উপর ভিত্তি করে ঐ ব্যবহারকারী নিউজফীডে কী ধরণের কন্টেন্ট দেখবে তা নির্ধারণ করে।

গতিবিধি বলতে এখানে ব্যবহারকারী, স্যোশাল মিডিয়ায় কী ধরণের পোস্টে লাইক করছে, কমেন্ট করছে, অনলাইনে স্যোশাল মিডিয়ার বাইরে কী ধরণের ওয়েবসাইট ভিজিট করছে, এমনকি কোন পোস্টে কতক্ষণ সময় অপেক্ষা করছে এসবকে বোঝানো হচ্ছে।

আপনি যে জায়গায় বেশি সময় ব্যয় করেন, যে পোস্টগুলোতে লাইক বা কমেন্ট করেন; মেশিন লার্নিং প্রোগ্রাম ধরে নেই ঐ ধরণের পোস্ট আপনার পছন্দ এবং সে অনুযায়ী আপনার নিউজফীডে কন্টেন্ট সরবরাহ করে দেয়।

একই পদ্ধতিতে আপনি কী ধরণে বিজ্ঞাপন দেখতে পছন্দ করবেন সেটাও বুঝতে পারে। ফলে সেই ধরণের বিজ্ঞাপনও আপনার নিউজফীডে দেখিয়ে থাকে।

আরও পড়তে পারেনঃ ফোনের এয়ারপ্লেন মোড আসলে কী? কীভাবে কাজ করে এটা?

অ্যালগরিদম দ্বারা তৈরী ফীডের বাইরে স্যোশাল মিডিয়ার আরেকধরণের ফীডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যাকে ক্রনোলজিক্যাল ফীড বলা হয়ে থাকে। এটা আপনার পছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং সময় অনুযায়ী আপনার ফলোকরা বিভিন্ন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পোস্ট দেখিয়ে থাকে।

তবে, এক্ষেত্রেও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে স্যোশাল মিডিয়া কোম্পানি আপনার আগ্রহের জায়গাটা শনাক্ত করতে পারে। এবং সে অনুযায়ী আপনাকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখিয়ে থাকে। যেসব স্যোশাল মিডিয়া প্লাটফরমে ক্রনোলজিক্যাল ফীড ব্যবহারের সুযোগ আছে, সেসব প্লাটফরমে ব্যবহারকারীকে সিলেক্ট করে দিতে হয় যে, সে অ্যালগরিদমিক ফীড দেখবে না ক্রনোলজিক্যাল ফীড দেখবে।

যে কারণে স্যোশাল মিডিয়া এধরণের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে

সহজ ভাষায় স্যোশাল মিডিয়ার এধরণের অ্যালগরিদম ব্যবহার করার মূল কারণ হচ্ছে, আপনাকে তাদের প্লাটফরমে আরও বেশি সময় ধরে রাখা। আপনি যদি একের পর এক আপনার মনমতো পোস্ট দেখতে থাকেন, তাহলে আপনি স্বাভাবিকভাবেই সেখান থেকে বের হতে চাইবেন না।

অনেক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞই বিষয়টি ড্রাগের নেশার সাথে তুলনা করে থাকেন। প্রথম প্রথম ব্যবহারকারী অল্প সময় বা প্রয়োজনে স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে দেখা যায়, নিজেদের অজান্তেই এখানে তারা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছে। এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ করা আর সম্ভব হয় না। যার প্রভাব জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রে পড়ে। পড়াশোনা, কাজকর্ম সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন স্যোশাল মিডিয়া এধরণের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে? এর উত্তরটাও বেশ সহজ। টাকা। হ্যাঁ, টাকার জন্যই স্যোশাল মিডিয়া এরকম বিপদজনক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে।

খেয়াল করলে দেখবেন, প্রায় সব স্যোশাল মিডিয়াই ফ্রীতে ব্যবহার করা যায়। যার অর্থ ফ্রীতে বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রাখা যায় শুধু ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে। কখনো কী ভেবে দেখেছেন, এসব কোম্পানি কীভাবে তাদের খরচ যোগাড় করে? কর্মীদের বেতন, অফিসের ব্যায়ভার বহন করে, প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ আয় করে?

আরও পড়তে পারেনঃ ক্লাউড কম্পিউটিং কী? এ সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার

এদের সেবা ব্যবহারের জন্য আমি বা আপনি কিন্তু একটা টাকাও দিই না। কেউ আবার ভেবে বসবেন না, ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার টাকা থেকে স্যোশাল মিডিয়া একটা অংশ পায়। এটা কখনোই হয় না। ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার টাকা শুধুমাত্র ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পায়।

তাহলে স্যোশাল মিডিয়ার আয়ের উৎস কী? স্যোশাল মিডিয়ার আয়ের উৎস হচ্ছে বিজ্ঞাপন। পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য কোম্পানি এখানে বিজ্ঞাপন প্রচার করে তাদের পণ্য বিক্রি করে। আর এই বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য স্যোশাল মিডিয়াগুলো কোম্পানি থেকে টাকা নেয়।

একটি বিজ্ঞাপন আপনার স্ক্রিনে কতোক্ষণ থাকলো, সেই ব্যপারটিকে বলা হয়, ইম্প্রেশন। প্রতিটা ইম্প্রেশনের বিনিময়ে স্যোশাল মিডিয়া কোম্পানি থেকে টাকা পায়। এর বাইরে কোন পণ্য যদি ব্যবহারকারী কেনেন সেক্ষেত্রে আরও বেশি টাকা পায় স্যোশাল মিডিয়া।

বুঝতেই পারছেন, আপনি বেশি সময় স্যোশাল মিডিয়ায় থাকার অর্থ বিজ্ঞাপনের ইম্প্রেশন বেড়ে যাওয়া, স্যোশাল মিডিয়ার ইনকামও বেড়ে যাওয়া। শুধু আপনার সময় নষ্ট হওয়া। তাই, আপনাকে বেশি সময় সময় ধরে স্যোশাল মিডিয়ায় ধরে রাখতেই আপনার পছন্দের কন্টেন্টগুলো দেখানো প্রয়োজন। আর একারণেই স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম ব্যবহার করে হয়ে থাকে।

স্যোশাল মিডিয়া কোম্পানি কী আপনার নিউজফীড নিয়ন্ত্রণ করে?

এই প্রশ্নের উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না। প্রত্যাক্ষ ভাবে কোম্পানি আপনার নিউজফীডে কী দেখা যাবে তা নির্বাচন করে দেয় না। এমনকি আপনি কী পোস্ট করছেন, কী পোস্ট দেখছেন সেটাও কোম্পানির কোন কর্মী দেখে না বা যাচাই করে দেয় না। তাই, বলা যায় কোম্পানি আপনার নিউজফীড নিয়ন্ত্রণ করে না।

তবে, তাদের তৈরী করা অ্যালগরিদম আপনার পছন্দের ভিত্তিতেই শুধুমাত্র আপনার নিউজফীড সাজিয়ে দেয়। যে পোস্টগুলো আমার পছন্দের সাথে যায় না, সেগুলো সরিয়ে রাখে। তাই, এই দিক থেকে বলা যায় পরোক্ষভাবে স্যোশাল মিডিয়া আপনার নিউজফীড নিয়ন্ত্রণ করে।

আরও পড়তে পারেনঃ অ্যান্ড্রয়েড স্কিন কী? এ সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার

তবে, যেহেতু মানুষ এই কাজটি করে না, তাই প্রায় সবকিছুই স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করার সুযোগ থাকে। সাধারণত এমনিতে স্যোশাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম কোন পোস্টই সাধারণত মুছে দেয় না। ফলে বিভিন্ন অনৈতিক, ক্ষতিকর পোস্ট বাস্তব জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আপনি পছন্দ না করলেও, অনেকেই এধরণের পোস্ট পছন্দ করেন। অ্যালগরিদমের সাহায্য তাদের নিউজফীডে এসব পোস্ট দেখানো হয়।

শেষকথা

সবকিছুরই ভালো এবং মন্দ দুইটা দিক থাকে সবসময়। স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদমের ব্যাপারেও সেই কথাটি প্রযেজ্য। আপনি যেমন হবেন, অ্যালগরিদম তেমনটাই করে দিবে আপনার নিউজফীড।

তবে, মানুষের ভালোর থেকে মন্দের প্রতি একটি সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। যেটাকে গুরুত্ব মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করা খুবই অন্যায়। প্রায় সব স্যোশাল মিডিয়াই নিজেদের লাভের জন্য কাজটি করে থাকে। অ্যালগরিদমকে এমনভাবে ডিজাইন করে, যেন করে মানুষ যা দেখতে পছন্দ করে তাই দেখানো যায়।

এর কারণে দুইটা ক্ষতি হয়। এক, মন্দের প্রতি মানুষের ঝুঁকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দুই, স্যোশাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি তৈরী হয়। যা জীবনকে জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।

তাই, স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারের ব্যাপারে আমাদের সবসময়ই সচেতন থাকা প্রয়োজন। স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম নিয়ে এই লেখাটি আপনার কাছে কেমন লাগলো? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টে জানিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করবেন। আর লেখাটি আপনার ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে নিতে ভুলবেন না।


3 Comments

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের নাম অ্যাপল হলো কেন? - কেন্দ্রবাংলা · April 11, 2022 at 2:38 pm

[…] আরও পড়তে পারেনঃ স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম : যা আপনাকে … […]

মিনিমালিস্ট ফোন কী জিনিস? কেন দরকারি? - কেন্দ্রবাংলা · November 13, 2022 at 12:14 am

[…] আরও পড়তে পারেনঃ স্যোশাল মিডিয়া অ্যালগরিদম : যা আপনাকে … […]

  • Leave a Reply

    Avatar placeholder

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    2023 © KendroBangla | All Rights Reserved