নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, একটা স্যামসাঙ অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন এবং একটা শাওমী অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনের ফাংশনগুলো দেখতে একরকম হয় না। এমনকি একই অ্যান্ড্রয়েড ভার্সনের অপারেটিং সিস্টেম হওয়ার হওয়ার পরও এদের মধ্য বেশ দৃশ্যমান পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এমনটা হওয়ার কারণ কী?

শুধু স্যামসাঙ কিংবা শাওমী নয়, একই অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন ব্যবহার করার বড় বড় যে কোন কোম্পানির ফোনের ফাংশনগুলো দেখতে হুবহু একই রকম হয় না। এর কারণ হচ্ছে, সব বড় বড় কোম্পানিই নিজেরা “অ্যান্ড্রয়েড স্কিন” তৈরী করে সেটা তাদের ডিভাইসে ব্যবহার করে থাকে। যাতে করে অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েড হলেও তাতে একটা স্বকীয়তা বজায় থাকে।

অ্যান্ড্রয়েড স্কিন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু জিনিস সম্পর্কে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। এতে করে বিষয়টি বোঝা বেশ সহজ হবে। তাই, আমরা শুরুতে স্টক অ্যান্ড্রয়েড কী তা জেনে নিয়ে তারপর অ্যান্ড্রয়েড স্কিন আসলে কী, কেন ডিভাইস প্রস্তুতকারী কোম্পানি অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমকে মোডিফাই করতে পারে এসব নিয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশ করবো।

অ্যান্ড্রয়েড স্কিন সম্পর্কে যা কিছু জানা প্রয়োজন

স্টক অ্যান্ড্রয়েড

অ্যান্ড্রয়েড হচ্ছে মূলত লিনাক্স ভিত্তিক একটি ওপেনসোর্স অপারেটিং সিস্টেম। যার অর্থ এর কোড যে কেউ দেখতে পারবে এবং সেটা ব্যবহার করতে পারবে। প্রয়োজন হলে মোডিফাই করেও ব্যবহার করতে পারবে। অনেকটা উবুন্টু কিংবা ডোবিয়ানের মতো। পার্থক্য হচ্ছে, উবুন্টু কিংবা ডোবিয়ানকে কম্পিউটারের জন্য তৈরী করা হয়, আর অ্যান্ড্রয়েডকে তৈরী করা হয় ফোনের জন্য।

অ্যান্ড্রয়েড স্কিন

অ্যান্ড্রয়েডের মূল অপারেটিং সিস্টেমটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং আপডেটের কাজটি করে থাকে গুগল। তারা অ্যান্ড্রয়েড ওপেন সোর্স প্রজেক্টের মাধ্যমে কোডটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের একদম বেসিক রূপ এটি। এটাকেই মূলত “স্টক” বা “ভ্যানিলা” অ্যান্ড্রয়েড বলা হয়।

যে কেউ এই স্টক কোড কপি করে নিয়ে সেটাকে কাজে লাগাতে পারে কিংবা মোডিফাই করতে পারে। ভাববেন না, গুগল অনেক উদার, স্বার্থহীন ফ্রীতে এই কাজটা করে। গুগলের এখানে অনেক অনেক বড় লাভের জায়গা আছে। তবে সেটা আজকের আলোচনা বিষয় না।

যাইহোক, সামসাঙ কিংবা শাওমীর মতো অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখান থেকেই মূল অ্যান্ড্রয়েডের কোডটি নেয়। এবং এরপর তারা এটাকে নিজেদের মতো করে মোডিফাই করে নিজেরদের ডিভাইসে ব্যবহার করে।

অ্যান্ড্রয়েড স্কিন

খুব সহজ ভাষায় অ্যান্ড্রয়েড স্কিন হচ্ছে, স্টক অ্যান্ডয়েডের এই মোডিফাইড ভার্সন। অর্থাৎ কোম্পানিগুলো স্টক অ্যান্ড্রয়েড নিয়ে যখন সেটাকে নিজেদের মতো করে মোডিফাই করে নেয় তখন সেটাকে অ্যান্ড্রয়েড স্কিন বলা হয়।

বড় বড় সব কোম্পানিই তাদের ডিভাইস ব্যবহারকারীদের একটু ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স এবং ক্ষেত্র বিশেষে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য সরাসরি স্টক অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার না করে এসব অ্যান্ড্রয়েড স্কিন ব্যবহার করে। খুব জনপ্রিয় এরকম কিছু অ্যান্ড্রয়েড স্কিন হচ্ছে,

  • গুগলের পিক্সেল ইউআই (Pixels UI)
  • স্যামসাঙের ওয়ান ইউআই (One UI)
  • শাওমীর মিইউআই (MIUI)
  • এলজির ইউএক্স (UX)
  • ওয়ানপ্লাসের অক্সিজেনওএস (Oxyzen OS)
  • অপ্পো বা রিয়েলমির কালার ওএস (Color OS)

অ্যান্ড্রয়েড স্কিন শুধু মাত্র ইউজার ইন্টারফেস নয়

প্রতিটি অ্যান্ড্রয়েড স্কিনই দেখতে একটা আরেকটার থেকে ভিন্নরকম অর্থাৎ ইউজার ইন্টারফেস আলাদা। একারণেই মূলত, এগুলোর শেষে ইউআই (UI) যুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এতোটুকুই কি অ্যান্ড্রয়েড স্কিনের একমাত্র বৈশিষ্ট্য? একদমই না।

আগের বলেছিলাম, প্রতিটি কোম্পানি তাদের ডিভাইস ব্যবহারকারীদের একটু আলাদা রকমের এক্সেপেরিয়েন্স এবং সুবিধা দেওয়ার জন্য স্টক অ্যান্ড্রয়েড মোডিফাই করে। ফলে, ইউজার ইটারফেসের পাশাপাশি এতে প্রতিটি অ্যান্ড্রয়েড স্কিনের ব্যবহারকারীরা এক্সট্রা কিছু ফিচার পেয়ে থাকে।

উদাহরণ স্বরূপ, শাওমী মিইউআই এর কথা বলা যেতে পারে এখানে। অ্যান্ড্রয়েড ৭ থেকে স্প্লিট স্ক্রিন ফিচারটি ব্যবহার করার সুযোগ পায় ব্যবহারকারীরা। কিন্তু শাওমীর বেশ কিছু পুরাতন ফোনে (রেডমি ৩এস) এই অ্যান্ড্রয়েড ৭ ভার্সনটি ইন্সটল করার উপায় ছিলো না।

অ্যান্ড্রয়েড ৭ ইনস্টল করার জন্য যেমন হার্ডওয়্যার প্রয়োজন তেমন হার্ডওয়্যার এসব ফোনে না থাকায় এ সমস্যাটি দেখা দেয়। তখন শাওমী তাদের অ্যান্ড্রয়েড স্কিন মিইউআই ১০-এ এই ফিচারটি যুক্ত করে দেয়। যেটা তৈরী করা হয়েছিলো অ্যান্ড্রয়েড ৬ ভার্সনের উপর ভিত্তি করে। এর অ্যান্ড্রয়েড ৭ নাহয়েও মিইউআই ১০ এর মাধ্যমে পুরাতন ফোন ব্যবহারকারীরা স্লিপ্ট স্ক্রিন ফিচারটি ব্যবহার করার সুযোগ পায়।

ওয়ান ইউআই

সামসাঙের ওয়ানইউআই কিংবা ওয়ানপ্লাসে অক্সিজেনওএসে এ রকম আরও অনেক ফিচার রয়েছে সেগুলো স্টক অ্যান্ড্রয়েডে পাওয়া যায়। শুধু স্যামসাঙ, শাওমী বা ওয়ানপ্লাসই না প্রায় সব অ্যান্ড্রয়েড স্কিনেই এরকম কিছু ব্যাপার থাকে। তাই, অ্যান্ড্রয়েডকে স্কিনকে খুব খাটো করে দেখার সু্যোগ নেই।

ইউজার ইন্টারফেস এবং ফিচারের দিক থেকে অনেকটা ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও এদেরকে আলাদা অপারেটিং সিস্টেম না বলে অ্যান্ড্রয়েড স্কিন বলার মূল কারণ হচ্ছে, এর সবাই স্টক অ্যান্ড্রয়েড থেকে তৈরী। যার ফলে বেসিক কিছু ফিচার এদের সবারই এক।

সব অ্যান্ড্রয়েড স্কিনেই আপনি একই অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করতে পারবেন। সবগুলোরই সিকিউরিটি প্রায় একই মানের। অপারেটিং সিস্টেম মূল গঠনও একই রকমের। অপশনে ভিন্নতা থাকলেও আপনি যে কোন স্কিনের অ্যান্ড্রয়েড ফোনই স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারবেন। সামসাঙের ব্যবহারকারী হলেও একটি ওয়ানপ্লাস ফোন ব্যবহার করতে আপনার কোন সমস্যাই হবে না।

অ্যান্ড্রয়েড স্কিনের সুবিধা অসুবিধা

এতোক্ষণের আলোচনায় আশাকরি অ্যান্ড্রয়েডের স্কিনের সুবিধাগুলো বুঝে গেছেন। ইউজার ইন্টারফেসের ভিন্নতা, আলাদা আলাদা ইউনিক ফিচার এসবই সম্ভব হয় অ্যান্ড্রয়েডের স্কিনের জন্য। অ্যান্ড্রয়েড স্কিনের বেলায় আপনাকে অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না।

আপনার ফোন অ্যান্ড্রয়েডের আপডেট ভার্সন সমর্থন করার উপযোগী হোক না না হোক, আপনার অ্যান্ড্রয়েড স্কিন আপডেটেড হলে খুব ভালো সম্ভাবনা থাকে আপডেট অ্যান্ড্রয়েডের ফিচারগুলো পাওয়ার। যেটা যে কোন ব্যবহারকারীর জন্যই একটি ভালো বিষয়।

যদিও অনেকে অভিযোগ করেন, অ্যান্ড্রয়েড স্কিনের স্টক অ্যান্ড্রয়েডের লেটেস্ট ফিচারগুলো পেতে অনেক সময় লাগে। অভিযোগটি পুরোপুরি মিথ্যা নয়। প্রতিবছর শেষ প্রান্তিকে মূলত স্টক অ্যান্ড্রয়েডের ভার্সন আপডেট রিলিজ করে গুগল। যেহেতু স্টক অ্যান্ড্রয়েডের কাজটা গুগল করে থাকে, তাই তাদের পিক্সেল ফোনে এটা সবার আগে পাওয়া যায়।

কালার ওএস

সে তুলনায় বেশ দেরীতে এই আপডেট আসে অন্যান্য অ্যান্ড্রয়েড ফোনে। কারণ, কোম্পানিগুলো গুগলের রিলিজ করা সেই আপডেট নিজেদের মতো করে মোডিফাইড করে তাদের স্কিন আপডেট করে।

ফলে, বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় এসব ফোনে মেজর আপডেট আসতে। একটা একটা অসুবিধা অ্যান্ড্রয়েড স্কিনের। স্টক অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার করে কোন কোম্পানি অ্যান্ড্রয়েড স্কিন তৈরী করার পর সেটাকে গুগল থেকে সার্টিফাইড করে নিতে হয়।

অ্যান্ডয়েড স্কিন তৈরীতে যে কারো স্বাধীনতা থাকলেও গুগল কিছু শর্ত বেঁধে দেয় ডেভেলপারদের। যারা সেই শর্তগুলো মেনে স্টক অ্যান্ড্রয়েডকে কাস্টোমাইজ করে তাদের গুগল থেকে সার্টিফাইড করা হয়। এবং এসব স্কিন ইনস্টল করা ডিভাইসকে অ্যান্ড্রয়েড সার্টিফাইড ডিভাইস বলা হয়।

শেষকথা

কয়েক বছর আগে কাস্টম রম নামে একধরণের অ্যান্ড্রয়েড স্কিন প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিলো। যেগুলো এক বা একাধিক ডেভেলপার মিলে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে তৈরী করত। এসব বেশিরভাগেই কিছু না কিছু ত্রুটি থাকতো। ফলে, গুগলের সব শর্তপূরণ করতে পারতো না। সিকিউরিটির দিক থেকে অনেক দুর্বল হতো।

বর্তমানে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো রীতিমতো গবেষণা করে অফিশিয়ালি এসব অ্যান্ড্রয়েড স্কিন তৈরী করে থাকে। ফলে, এগুলোর এধরণের সমস্যা নেই বললেই চলে। তাছাড়া, সব এখন প্রায় সব অ্যান্ড্রয়েড স্কিনই গুগল সার্টিফাইড

তাই, কোন অ্যান্ড্রয়েড স্কিন ব্যবহার করছেন সেটা ভেবে দুশ্চিন্তা করার একদমই কোন কারণ নেই। সব অ্যান্ড্রয়েডই স্কিনই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। একটা থেকে আরেকটা ভালো এমন বলারও তাই সুযোগ নেই একেবারেই। আপনার কাছে ভালো লাগলেই সেটা ভালো। আর হ্যাঁ, আপনি পছন্দের অ্যান্ড্রয়েড স্কিন কোনটি সেটা কিন্তু কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।


1 Comment

  • Leave a Reply

    Avatar placeholder

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    2023 © KendroBangla | All Rights Reserved