রাতে আকাশে চাঁদ কিংবা তারার মিটিমিটি আলো দেখতেই অভ্যাস্ত আমরা। বড়জোর উল্কাপাত বা উড়জাহাজের আলো। তবে এই জিনিসগুলোর ছাড়াও কিন্তু রাতের আকাশে আরেক ধরণের আলো দেখা যায়। সেটা হচ্ছে, আরোরা বা মেরুজ্যোতি! আকাশে রঙ বেরঙের নেচে বেড়ানো এই আলো দেখার অনুভূতি অন্যকোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না।
তবে দুঃখের কথা হচ্ছে, আমি বা তুমি খুব সহজেই বাস্তবে এই আরোরার দেখা পাই না। কারণ, এই আলো শুধুমাত্র দেখা যায় আমাদের পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলে। মেরু অঞ্চলের বাসিন্দা না হওয়ায় আরোরা নিজ চোখে দেখার তাই একমাত্র উপায় তাই উত্তর অথবা দক্ষিণ মেরু ভ্রমণ করা। সেটা বড় হলে তোমরা দেখে আসতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
এখন যেহেতু আরোরা দেখতে যাওয়া যাচ্ছে না, তাই এই সময়ে আরোরা সম্পর্কে আমরা কিছুটা জেনে নিতে পারি। কোনকিছু জেনে দেখা আর না জেনে দেখার মাঝে অনেক পার্থক্য। জানার পরে দেখলে আনন্দটা অনেক বেড়ে যায়। আরও গভীরভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তাছাড়া, জানার নিজস্বও একটা আনন্দ আছে, কী বলো?
আমরা তাই আজকের এই লেখাটায় আরোরা সম্পর্কে জানবো। এটা আসলে কীসের আলো? কীভাবেই বা তৈরী হয়? আর কেনই বা শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলে এটা দেখা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবো খুব সহজ ভাষায়। তাই, শেষ পর্যন্ত সাথেই থেকো কিন্তু।
আরোরা বা মেরুজ্যোতি কী?
এতোক্ষণ আরোরা সম্পর্কে হয়তো একটা ধারণা পেয়েছো। মেরু অঞ্চলে রাতের আকাশে নানা রঙের যে অপূর্ব আলো খেলা করে তাকে আরোরা বা মেরুজ্যোতি বলে। উত্তর এবং দক্ষিণ দুই মেরুতেই আরোরার দেখা মেলে।
উত্তর মেরুর মেরুজ্যোতিকে বলা হয় অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দান লাইট। আর দক্ষিণ মেরুরটাকে বলা হয়, আরোরা অস্ট্রালিস বা সাউর্দান লাইট।
এ চমৎকার আলো অবশ্য দিনের বেলায় দেখা যায় না। দেখা যায় শুধু রাতের আকাশে। তবে, আরোরা কিন্তু মোটেও চাঁদের আলো নয়।

আরোরা বা মেরুজ্যোতি তাহলে কীসের আলো?
রাতের বেলা দেখা গেলেও আরোরা মূলত সূর্যের আলো। কী অবাক হচ্ছো? ভাবছো সূর্যের আলো আবার রাতে বেলা দেখা যায় কীভাবে?
আসলে সূর্য থেকে আমরা আলো বা তাপ ছাড়াও আরও নানাকিছু পাই। প্রচুর পরিমাণে শক্তি (Energy) এবং ক্ষুদ্র কণা প্রতি মূহুর্তেই সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো সৌরজগতে। আসছে আমাদের পৃথিবীতেও।
কিন্তু পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র অদৃশ্য ঢালের ভূমিকা পালন করছে। আমাদের জন্য ক্ষতিকর সেই শক্তি বা তরঙ্গগুলোকে আটকে দিচ্ছে বা ফিরিয়ে দিচ্ছে আমরা কোনকিছু বোঝার আগেই!
তবে, সূর্য সবসময় একই পরিমাণে শক্তি পাঠায় না। সূর্যের বায়ুমন্ডলের অবস্থা সবসময় একরম থাকে না। সৌর বায়ু বা সোলার উইন্ডের মাঝেও ঝড়ের সৃষ্টি হয় মাঝে মাঝে। একে বলা হয় সোলার স্ট্রম বা সৌরঝড়।
সৌরঝড়ের সময় সূর্যতে করোনাল ম্যাস ইজেকশন (Coronal mass ejection) নামে একটা ব্যাপার ঘটে। এ সময় সূর্য থেকে বেরিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণে ইলেক্ট্রিফাইড গ্যাস। যেগুলা প্রচণ্ড বেগে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়তে পারোঃ সূর্যের বয়স কতো? কীভাবে জানলাম সূর্যের বয়স?
যখন সৌরঝড়ের ঝাপটা আমাদের পৃথিবীতে এসে লাগে, তখন সূর্য থেকে আসা কিছু কণা এবং এনার্জি পৃথিবীর চৌম্বক বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড উপেক্ষা করে মেরু অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। এবং আমাদের বায়ুমন্ডলের গ্যাসের সাথে সেই কণাগুলো মিথস্ক্রিয়া (Interact) করে।

ফলাফল আকাশে হিসেবে তৈরী হয় অনিন্দ্য সুন্দর আলোর প্রদর্শনী! আলাদা আলাদা রঙের জন্য বায়ুমন্ডলের আলাদা আলাদা গ্যাস দায়ী। যেমন, অক্সিজেন যখন সূর্য থেকে আসা কণার সাথে মিথস্ত্রিয়া (Interact) করে তখন আকাশে দেখা যায় সবুজ এবং লাল আলো। আবার নাইট্রোজেনের বেলায় এই আলোর রঙ পরিবর্তন হয়ে নীল এবং বেগুনী হয়ে যায়!
কেন আরোরা শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলেই দেখা যায়?
তোমরা অনেকেই হয়ত কম্পাস দেখেছো। যা মধ্য চুম্বকের একটা কাঁটা থাকে। কম্পাসটা যেদিকেই ঘোরানো হোক না কেন, কাঁটা সবসময়ই উত্তর এবং দক্ষিণ বরাবর থাকে। কেন এমন হয়?
এর উত্তর হচ্ছে, আমাদের পৃথিবীটা নিজে বিশাল একটা চুম্বক। এর উত্তর এবং দক্ষিণ প্রান্ত হচ্ছে, সেই চুম্বকের বিশাল দুইটি মেরু। তাই মেরু অঞ্চল বাদে পৃথিবী যে কোন জায়গাতেই তুমি একটা দন্ড চুম্বক বা শলাকা চুম্বক রাখলে সেটা উত্তর দক্ষিণ মেরু বরাবর থাকবে।
বিশাল এই চুম্বকত্বের কারণে পৃথিবীর চারপাশে তৈরী হয়ে আছে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র। তবে, এই সুরক্ষা ঢাল পুরোপুরি গোলাকার না। এর কারণ, চুম্বকের বলরেখার বৈশিষ্ট্য।
তোমরা নিশ্চয়ই জানো, চুম্বকের দুই মেরুতে আকর্ষণ শক্তি খুবই বেশি থাকে। মাঝখানে থাকে অনেক কম। এছাড়া চুম্বকের বিপরীত মেরু পরষ্পরকে খুব আকর্ষণ করে। ফলে দেখা যায়, চুম্বকের উভয়পাশেই এক মেরু থেকে আরেক মেরু পর্যন্ত অর্ধগোলাকৃতি অসংখ্য বলরেখার তৈরী হয়। এতে করে চৌম্বকের চারপাশে সমান চৌম্বকক্ষেত্র তৈরী হয় না। মেরু অঞ্চলে চুম্বকক্ষেত্রের পরিসর অনেক কম থাকে।
পৃথিবীর বেলাতেও সেটা সত্যি। পূর্ব বা পশ্চিম গোলার্ধের চারপাশে যতো বিস্তৃতভাবে চুম্বকক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে। উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে তেমনটা নেই। তাই, সৌরঝড়ের সময় আমার কিংবা তোমার বাসার আশেপাশের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র যেভাবে সূর্যের কণা ও এনার্জি আটকে দেয় মেরু অঞ্চলে সেভাবে সম্ভব হয় না!

একারণেই মেরু অঞ্চলেই শুধু আরোরার দেখা মেলে। আরোরা নিয়ে আরো জানতে পারবে এখান থেকে।
অন্য গ্রহগুলোর কী অবস্থা?
এতোক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো, আরোরা কী এবং কেন হয়। এবার হয়ত্ মনে প্রশ্ন জাগছে, পৃথিবীর মতো কী অন্যান্য গ্রহে আরোরা দেখা যায়?
উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। পৃথিবীর মতো সৌরজগতের অনেক গ্রহেই আরোরার দেখা মেলে। আসলে কোন গ্রহের যদি চুম্বকক্ষেত্র থাকে, তাহলে সেখানে আরোরা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহার করে শনি আর বৃহস্পতি গ্রহের চমৎকার আরোরার ছবি তুলেছেন। নিচে তোমাদের জন্য সেগুলো দেওয়া হলো।

আরোরা নিয়ে বকবকানি আজকের মতো শেষ। আশা করছি, চমৎকার এই ব্যাপারটি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছো। কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে কিংবা প্রশ্ন থাকলে সেটা নিয়ে নিজেরা গবেষণা করবে। আমাদেরকে তো অবশ্যই প্রশ্ন করবে। আমরা চেষ্টা করবো তোমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে ইনশাআল্লাহ।
তবে, আমরা চাই সবকিছু নিয়ে তোমরা আগে নিজেরা গবেষণা করো। নিজেরা খুঁজে উত্তর বের করার চেষ্টা করো। এতে করে তোমাদের মস্তিষ্কটা পাওয়ারফুল হয়ে যাবে। কীভাবে খুব সহজে ছোটখাটো পর্যায়ে গবেষণা শুরু করতে হয় সেটা নিয়ে যদি জানতে চাও, তবে কমেন্টে আমাদেরকে জানাতে পারো। তোমার মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
1 Comment
পদার্থবিজ্ঞান কি? সহজ ভাষায় পদার্থবিজ্ঞানের পরিচয় - কেন্দ্রবাংলা · May 10, 2022 at 12:22 am
[…] আরও পড়তে পারোঃ আরোরা বা মেরুজ্যোতি কী? কীভাবে তৈরী হয়… […]