পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন প্রায় প্রত্যেক মানুষ খাদ্য উৎপাদনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলো। আর সভ্যতার সূচনা ঘটে কৃষির হাত ধরে। প্রাথমিক পর্যায়ে বন্য পরিবেশ থেকে খাদ্য সংগ্রহ প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত কাজ ছিলো। তাই সে সময়ে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারও ছিলো যথেষ্ট কম।

কৃষি আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনে আসে নিরাপত্তা। খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যায় অনেকটাই। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্পে নিজেদের উন্নত করার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে কমে আসে মৃত্যু হার। উল্লেখযোগ্য হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির শুরুটা হয় সেখানেই।

সপ্তদশ শতকের শেষভাগে শিল্প বিল্পবের পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেড়ে যায় বহুগুণে। উনবিংশ শুরুতে যেখানে পুরো পৃথিবীজুড়ে জনসংখ্যা ছিলো মাত্র ১ বিলিয়ন। সেখানে মাত্র তিন দুই শতাব্দীর ব্যবধানে একবিংশ শতকে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৫ বিলিয়ন।

কৃষিক্ষেত্রে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য যে বেশি খাদ্য প্রয়োজন এতো সহজ হিসাব। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে পাল্লা দিয়ে কি খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে? উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যাথুসের মতে, জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। আর খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে গাণিতিক হারে। যার অর্থ মানব সভ্যতা যতো উন্নতি এবং সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে, খাদ্যের চাহিদাও বাড়বে ততটা। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার একই রকম থাকলে একসময় সেই চাহিদা যোগান দেওয়া একসময় অসম্ভব হয়ে যাবে।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে আনতে পারে বিপ্লব
ফিচার ছবি

বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণে। থমাস ম্যাথুসের ভবিষ্যৎবাণি তাই অনেকটাই অকেজো এখন। তবে, দুশ্চিন্তার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, নগরায়ণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কমে যায় আবাদি জমির পরিমাণ। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সম্প্রতি ধারণা করছে, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে আরও ২ বিলিয়ন। নতুন এই দুইশো কোটি মানুষের খাদ্য এবং বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করা অদূর ভবিষ্যতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে তা বলা বাহুল্য।

ভার্টিকাল ফার্মিং এর ধারণা

এ সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে উর্ধ্বাধ চাষ ব্যবস্থা বা ভার্টিক্যাল ফার্মিং। বর্তমানে বিশেষ ধরণের এই চাষ ব্যাবস্থা খাদ্য উৎপাদনে দারুণ সাফল্য এনে দিয়েছে। এর সাথে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং অটোমোশন প্রযুক্তির প্রয়োগ হয়ত কৃষিক্ষেত্রে নিয়ে আসতে আমূল পরিবর্তন।

১৯৯৯ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ‎ডিকসন ডেসপোমিয়ার সর্বপ্রথম ভার্টিক্যাল ফার্মিং এর ধারণা দেন। যেখানে তাপমাত্রা, জলবায়ু এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আবদ্ধ জায়গায় চাষবাস করা হয়। এতে শস্য আনুভূমিক বরাবর রোপনা না করে উলম্বভাবে স্তরে স্তরে রোপন করা হয়। বর্তমানে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৭৪ একর জমিতে ভার্টিক্যাল ফার্মিং এর মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করছে। যেগুলো আশ্চর্য রকম সাশ্রয়ী। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন।

প্রযুক্তি ভিত্তিক কৃষি স্টার্ট-আপঃ প্ল্যানটি

স্যান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি ভিত্তিক কৃষি স্টার্ট-আপ “প্ল্যানটি” এরকম একটি প্রতিষ্ঠান। যারা ভার্টিকাল ফার্মিং এর সাথে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে তৈরী করেছে নতুন মাত্রা। প্রতিষ্ঠানটির রিপোর্ট অনুযায়ী, এ পদ্ধতিতে ৭২০ একর জমির সমপরিমাণ সবজি কিংবা ফল তারা উৎপাদন করতে তাদের প্রয়োজন হচ্ছে মাত্র ২ একর জমির।

যেভাবে ঘটছে দুই প্রযুক্তির সংমিশ্রণ

এই অভাবনীয় সাফল্য কিভাবে সম্ভব হলো তা জানতে হলে ভার্টিক্যাল ফার্মিং সম্পর্কে কিছুটা জেনে নিতে হবে। প্রথমত, পদ্ধতিতে চাষের জন্য কোন মাটির প্রয়োজন হয় না। উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করা হয় পানি এবং পরিবেশের মাধ্যমে। ফলে খুব অল্প জায়গাতে উলম্ব আকারে অনেক বড় শস্যক্ষেত্র তৈরী করা সম্ভব।

আরও পড়তে পারেনঃ টাইপরাইটার – বিস্ময়কর লেখার যন্ত্রটি যেভাবে কাজ করত

ভার্টিক্যাল ফার্মিং এর আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে আলো, তাপমাত্রা, জলবায়ু এবং সেচ ব্যবস্থা থাকে নিয়ন্ত্রিত। তাই, উদ্ভিদের চাহিদা অনুযায়ী এসব উপাদান সঠিকভাবে সরবরাহ করতে পারলে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া খুবই সহজ ব্যাপার। আর এখানেই কাজে লাগানো হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে।
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রায় নিখুঁতভাবে উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার ধারা, প্রকৃতি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে জানা যাচ্ছে চাহিদা। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সরবরাহ কাজও করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এর মাধ্যমেই।

ভার্টিক্যাল ফার্মিং এ সূর্যের আলোর পরিবর্তে এখানে ব্যবহার করা হয় নিয়ন্ত্রিত এলইডি আলো। ফলে উদ্ভিদের জন্য উপযোগী এমন সঠিক তরঙ দৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্কের আলো সরবরাহ করা যাচ্ছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। সেচ ব্যবস্থার পানি পরিশোধন করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। তাই পানির অপচয় হওয়ার কোন সুযোগ নেই এতে। প্ল্যানটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এভাবে ৯৯ শতাংশ কম আলো এবং ৯৫ শতাংশ কম পানির প্রয়োজন হয়।

ভার্টিকাল ফার্মিং এর নানা দিক

পরিবেশ আবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পোকামাকড় বা আগাছার আক্রমণের কোন সম্ভাবনা নেই। ফলে দরকার হচ্ছে না, কোন কীটনাশক বা আগাছানাশক রাসায়নিকের। বেশিরভাগ কাজই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় লোকবল লাগছে খুবই কম।

এর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি আশ্চর্যরকম সাশ্রয়ী এবং উৎপাদনশীল হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ন্যাট স্ট্যোরি বলেন, “১৫০০ একর জমির কথা কল্পনা করুন, যেটা এই প্রযুক্তিতে এঁটে যাবে একটা সুপারশপের মধ্য। পাশাপাশি একই পরিমাণ খরচে সাধারন জমির চেয়ে ৩৫০ গুন বেশি শস্য উৎপাদন করতে পারবেন এর মাধ্যমে।”

আরও পড়তে পারেনঃ পেরিস্কোপ : একটি সাধারণ কিন্তু বিস্ময়কর আবিষ্কার

প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে প্রকৃতির উপরে নির্ভর করতে হয় অনেকটাই। ফলে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মহামারি, বন্য, ঘুর্ণিঝড়ে সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মারাত্মক প্রভাব পড়ে খাদ্য উৎপাদনে। সেদিক থেকে এ ধরণের চাষ পদ্ধতি অনেকটা নিরাপদ।

কৃষিক্ষেত্রে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

তবে ভার্টিক্যাল ফার্মিং এখন পর্যন্ত সবজি কিংবা ফলের বাইরে শস্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য চাহিদার সঠিক জোগান দিতে হলে খাদ্যশস্যও উৎপাদন করার উপায় বের করতে হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার যে শুধুমাত্র ভার্টিক্যাল ফার্মিং এর ক্ষেত্রেই হচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়। সাধারণ কৃষি জমিতেও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে। আবহাওয়া, পরিবেশ এবং উদ্ভিদের আচরণ পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে কৃষককে বলে দিচ্ছে কোন সময়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সবচেয়ে উপযোগী হবে। এর ফলে একই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে শস্যের গুনগত মান ও উৎপাদন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার যে কৃষি ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে তুলছে একথা বলা বাহুল্য। ভবিষ্যতে খাদ্য চাহিদা মেটাতে তাই এর ভূমিকাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তবে এক্ষেত্রে সতর্ক থাকাটা জরুরী যে, সুফলের আশায় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার লাগামটা যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়।


তথ্যসুত্রঃ


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved