মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে পরিবর্তন ঘটেছে, আমাদের পরিবেশের, জীবনযাত্রার, চিন্তা-চেতনার, এমনকি বিশ্বাসের। কিন্তু যে আকৃত্রিম স্বভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি তা হলো কৌতুহল। মানুষ মাত্রই কৌতুহল কিংবা অজানাকে জয় করবার ইচ্ছে। যার প্রবল স্রোতে ভেসেছে, গভীর সমুদ্র থেকে সুউচ্চ পাহাড়, মহাবিশ্ব থেকে অতিক্ষুদ্র মাইক্রোস্কোপিক কণা।

কোন কিছুই মানুষের আদিম প্রাকৃত কৌতুহলের থেকে মুক্তি পায় নি। অজানাকে জয় করবার এই বুনো প্রয়াস শুধুমাত্র মানুষ তার ইচ্ছেতেই সীমাবদ্ধ করে রাখে নি। বরং সীমানা ছাড়িয়ে অসীমতার পথে গন্তব্য করে নিয়েছে। একের পর এক নতুন লক্ষ্য তৈরি করে, সীমাবদ্ধতাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করা হচ্ছে। সেগুলো সফলতার সহিত অতিক্রম করছে, পরমুহূর্তেই নতুন লক্ষ্যে, নতুন উদ্যমে পথ চলতে যেন আমরা এখন অভ্যস্ত।

বিজ্ঞানের এই যুগে সবই যেন সম্ভব। কিন্তু এত সব সম্ভাবনার মাঝেও যে ছোটোখাটো যে অপ্রাপ্তিগুলো রয়ে যায়; সেগুলোর গল্প শুনতে নিশ্চয়ই সবাই অতি উৎকণ্ঠা নিয়েই অপেক্ষা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আজ আমি সেরকমই একটি লেখা নিয়ে হাজির হয়েছি।

ভয়েনিচের পান্ডুলিপি : শত বছরের এক অমিমাংসিত রহস্য

বই আমাদের সবারই প্রিয় বন্ধু। যারা নিয়মিত পাঠক তাদের জন্যে তো কথাই নেই। সময়-সুযোগ, অর্থের যোগান, কিংবা মনমত বই পেলে তো কিনা চাই-ই চাই। কিন্তু কেমন হবে যদি এমনটা জানাই যে, পৃথিবীজুড়ে এক শতকের বেশি সময় ধরেও মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে শুধুমাত্র একটা বইকে পড়তে; তার অজানা ভাষাকে আয়ত্ত করতে। কিন্তু দুর্বোধ্য বইয়ের কাছে মানুষের সেই কৌতুহল যেন একরকম ছেলেখেলা। সেরকমই একটা গল্প বলবো আজ। চলুন তবে শুরু করা যাক!

ভয়েনিচের পান্ডুলিপি
ফিচার ছবি

শুরুর কথা

সময়টি ১৯১২ সাল। এক আমেরিকান ব্যবসায়ী কিছু প্রাচীন বইয়ের সন্ধানে রোমের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কিছু পুরনো বইসহ একটি ট্রাঙ্কের সন্ধান পেলেন। ট্রাঙ্কটিতে অনেকগুলো পুরাতন বই, পান্ডুলিপি, সহ বিভিন্ন কাগজপত্র ভর্তি ছিলো।

এর মাঝে একটি আলাদা গড়নের পান্ডুলিপি ব্যবসায়ীকে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করলো। তিনি পান্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে খুলে দেখলেন। দেখতে পেলেন একটি অজানা ভাষায় সম্পূর্ন পান্ডুলিপিটি রচিত। তিনি আরো খেয়াল করলেন, পান্ডুলিপিটি সম্পূর্ণই হাতের লেখা এবং অসংখ্য হাতে আঁকা চিত্র দিয়ে সজ্জিত।

যা ব্যবসায়ীর মনে অত্যন্ত কৌতুহলের জন্ম দেয়। তিনি নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বইটিকে ততক্ষণাৎ বগলদাবা করে নিলেন। উল্লেখ্য, এই ব্যবসায়ীর নামই হচ্ছে মিস্টার উইলফ্রিড ভয়েনিচ তার নামানুসারে পান্ডুলিপির নাম রাখা হয়েছে, ‘ভয়েনিচ ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ বা ‘ভয়েনিচের পান্ডুলিপি’ ।

অর্থ উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভয়েনিচ যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। সেখানে তিনি অনেক বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এই পান্ডুলিপির পাঠোদ্বারের জন্যে। কিন্তু কেউই কোনো সমাধানে পৌছুতে পারেন নি। পরবর্তীতে লোকমুখে ধীরক্রমে পান্ডুলিপিটির খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। ১৯২১ সালে এই পান্ডুলিপিটি নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয়। এরপর থেকেই এই অদ্ভুতুড়ে পান্ডুলিপিটির গল্প পৃথিবীব্যপি সমাদৃত হতে থাকল।

পরবর্তীতে এই রহস্য সমাধান করতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবীসেরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ ক্রিপ্টোগ্রাফাররা একের পর এক চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু কেউই সে রহস্যর কোন সমাধানে পৌছুতে পারেন নি। এছাড়াও একের পর এক আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এবং উন্নত কম্পিউটার ব্যবস্থার মাধ্যমে নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষাতেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সুফল মেলে নি। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স যারা জাপানের ভার্বাল কোডের অর্থ উদ্ধার করেছিলো, তারাও ব্যর্থ হয়েছে এই কোড পুনরুদ্ধার করতে।

আরও পড়তে পারেনঃ টাইপরাইটার – বিস্ময়কর লেখার যন্ত্রটি যেভাবে কাজ করত

ভয়েনিচ নিজেও বইটিকে বিভিন্ন উপায়ে পাঠোদ্ধার (ডিকোড) করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসার পূর্বেই পৃথিবী হতে তার বিয়োগ ঘটে। তার মৃত্যুর পর পান্ডুলিপিটি তার স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে আসে। পরবর্তীতে বারকয়েক তত্ত্বাবধান অদল বদলের পর ঘটনাক্রমে ১৯৬৯ সালে এই পান্ডুলিপিটি হান্স পি. ক্রাউস নামের একজন জনৈক ভদ্রলোকের হাতে আসে।

তিনি পান্ডুলিপিটিকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইনাকা রেয়ার বুক এবং ম্যানুস্ক্রিপ্ট লাইব্রেরিকে দান করেন। এভাবেই পান্ডুলিপিটি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেইনেক লাইব্রেরিতে স্থান পায়। বর্তমানে বইটি এই লাইব্রেরিতেই অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

ভয়েনিচের পান্ডুলিপি এক অমিমাংসিত-রহস্য
নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আজও সম্ভব হয়নি এর পাঠোদ্ধার

বলা হয়ে থাকে, বইটির বর্তমান মূল্য সর্বনিম্ন ৮০০০ ডলার থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ১০ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে।

কী আছে ভয়েনিচের পান্ডুলিপি তে?

ভয়েনিচের আবিষ্কারের পর আজ প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় পরেও হাতে রচিত সচিত্র বইটি এখনো পৃথিবীর কাছে অবাক বিষ্ময়! কই থেকে এলো বইটি? কে লিখলো? কি লিখা হয়েছে বইটি জুড়ে? এরকম হাজার টা প্রশ্নের ভিড় যেন দিন দিন বেড়েই চলছে।

পান্ডুলিপির প্রাথমিক ইতিহাসের বেশিরভাগ অংশই শুধুমাত্র অনুমেয়। ২০০৯ সালে, অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা রেডিওকার্বন ডেটিং সম্পাদন করে। এবং জানতে পারেন এই পান্ডুলিপিটির উৎপত্তি ১৪০৪ থেকে ১৪৩৮ সালের কোন একসময়ে। ২০১৪ সালের প্রোটিন পরীক্ষার ফলে জানা যায়, পার্চমেন্টটি বাছুরের চামড়া দিয়ে তৈরি হয়ে ছিলো। এবং পোলারিত আলোক মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার সাহায্য নিশ্চিত হয়েছেন বইয়ে আঁকা চিত্রগুলোর গঠন ও লিখাগুলোর জন্যে পাখির পালকের কলম ব্যবহার করা হয়েছিলো।

অনেকের মতে ভয়েনিচ পান্ডুলিপিটির সাম্ভাব্য লেখক হতে পারেন, দার্শনিক রজার বেকন, জ্যোতির্বিদ জন ডি, ইতালিয়ান প্রকৌশলি জিওভান্নি ফন্টানা, কিংবা ভয়েনিচ নিজেই। গুটিকয়েকের মতে, ভয়েনিচ নিজেই উদ্ভট অক্ষরের বিন্যাস ঘটিয়ে পৃথিবীজুড়ে রহস্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যশ এবং প্রতিপত্যি অর্জন করার ফন্দি করেছিলো। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোতে এরকম কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি। বরং তাদের কাছে পান্ডুলিপিটিকে অনেক বেশি অকৃত্রিম মনে হয়েছে।

‘লেটার-বেসড সাইফার’ (cipher) তত্ত্বমতে, অর্থবহ ইউরোপীয়ান কিছু ভাষাকে অস্পষ্টাকারে ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকটা একপ্রকারের অ্যালগোরিদমের মত করে পৃথক পৃথক বর্ণের সমন্বয়ে এই পান্ডুলিপিটি তৈরি করেছিলো। আবার স্ট্যাগ্যানোগ্রাফি তত্বানুসারে মনে করা হয়, পান্ডুলিপিটির পাঠ্য বেশিরভাগই অর্থহীন, তবে অনর্থক শব্দের আড়ালে হতে পারে অনেক বিশেষ অর্থবহ তথ্য লুকায়িত আছে।

ভয়েনিচের পান্ডুলিপিতে রয়েছে জ্যোর্তিবিজ্ঞান, রাশিচক্র, মহাজাগতিক বস্তুর মতো নানা ছবি
চিত্র ও লেখা সম্বলিত পান্ডুলিপির কিছু পৃষ্ঠা, সোর্সঃ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়

বইটির কিছু পাতা কালেরস্রোতে হারিয়ে গিয়েছে। ধারণা করা হয় মূল পান্ডুলিপিটির ২৭২ পৃষ্ঠার ছিলো। তবে বর্তমানে এর ২৪৩ পৃষ্ঠা অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। ১৭০০০০ অক্ষর দিয়ে সজ্জিত এই পান্ডুলিপিতে জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, জ্যোর্তিবিজ্ঞান, রাশিচক্র, মহাজাগতিক বস্তু, চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সর্বমোট ৬ টি বিভিন্ন বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। এ অনুমানটি শুধুমাত্র পান্ডুলিপিতে বিদ্যমান বিভিন্ন চিত্র থেকে অনুধাবন করা হয়েছে।

পান্ডুলিপির প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়েই বিদ্যমান ছবিগুলো লাল, নীল, হলুদ এবং সবুজ রঙে আঁকা হয়েছে। পান্ডুলিপির অর্ধেকের বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন অজানা উদ্ভিদের ছবি। এছাড়াও কিছু অংশে নক্ষত্র, মহাকাশ, বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা ইত্যাদি নিয়ে আঁকা ছবিও দেখা যায়।

আরও পড়তে পারেনঃ যদ্যপি আমার গুরু : জ্ঞান ও সরলতার অকৃত্রিম উপাখ্যান

অমিমাংসিত রহস্য এর ধুম্রজাল

মূলত পান্ডুলিপিটি পুরোটা ঘুরে দেখলে আপনার মনে অনেক কৌতুহলের জন্ম হবে। কেন এই পান্ডুলিপিটির আবির্ভাব হলো? এটা কে লিখেছিলো? কেনই বা লিখেছিলো? আদৌতে এর মাঝে কি কোনো গুপ্ত ভেষজ চিকিৎসাবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে, যা হয়ত এখনো আমাদের কাছে অজানা। আর লিখলেও কেনো এরকম গুপ্ত ভাষাতেই লিখা হলো? তাহলে কি লেখক চেয়েছিলেন কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী হতে নিজের এই গুপ্ত লিখনিকে আড়াল করতে?

আদৌতে এর মাঝে কি কোন গুপ্ত ভেষজ চিকিৎসাবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে
পান্ডুলিপিতে উদ্ভিদের ছবি এবং দুর্বোধ্য লেখা

এরকম হাজারটা প্রশ্ন মানুষের মনে এখনো ভিড় করছে বলেই এর সদুত্তর এখনো খোঁজা হচ্ছে। এর মাঝে অনেকেই অনেক তত্ত্ব ও বর্ণনা দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে তার বেশিরভাগই সঠিক বলে গন্য করলেও, অকাট্য প্রমাণ ও যুক্তিসাপেক্ষে প্রমাণিত না হওয়ার ফলে এখনো বিস্তর ধুম্রজালের মাঝেই আমাদেরকে বিরাজ করতে হচ্ছে।

ভয়েনিচের পান্ডুলিপি নিয়ে প্রচুর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। অনেক প্রামান্য চিত্রও রয়েছে। আপনি চাইলে ইন্টারনেট ঘেটে এই অমীমাংসিত রহস্য সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। এমনকি এই পান্ডুলিপিটিকে আপনি খুব সহজেই ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে নিতে পারবেন। এর একটি অনুলিপি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যেগে ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়।


মোঃ মারুফ আহমেদ

বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে বিষয়ে স্নাতক করছি। ভালো মানুষ হবার প্রচন্ড ইচ্ছে বুকে নিয়েই অনাগত পৃথিবীতে নিজের যাত্রা অব্যাহত রেখেছি।

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved