দুঃখ-দুর্দশা, শোকতাপ ভরা এই পৃথিবীতে যুগে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভাব হয় এমনকিছু মানুষের, যারা শুধু নিজেরা বাঁচেন না, বাঁচান চারপাশের সবাইকে। নিজেরা ভালো থাকেন না, ভালো রাখেন সবাইকে। সবাইকে নিয়ে দুঃখকষ্ট সরিয়ে সেখানে নিয়ে আসেন সুখের আলো। তাঁরা হাতে নিয়ে চলেন আলোকবর্তিকা। তাঁরা মহামানব। তাঁরা চির স্মরণীয়, চির বরণীয় এবং চির অনুকরণীয়। অমর এই মানুষগুলোর জীবনাদর্শ পথ দেখায় আমাদের পথচলায়। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ এসেছেন আলোর মশাল হাতে।
তবে মহামানব ও বাঙালি জাতির কথা বলতে গেলে দ্বিধাহীন চিত্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি বলা যায়। এবং বলতে হয়। তিনি বাঙালি জাতির জনক। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। শোষণ আর নিপীড়নে জর্জরিত বাঙালি জাতির বুকে জাগিয়ে তোলেন, নেতৃত্বদেন মুক্তিসংগ্রামের। অবশেষে বাঙালি পায় স্বাধীনতার সেই শান্তির পরশ। তিনি বাঙালি জাতিকে উপহার দেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। বিশ্বের বুকে স্বাধীন ও শান্তিকামী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন বাঙালীকে। একদিকে তিনি যেমন সফল রাষ্ট্রনায়ক, অন্যদিকে লাখোও বীরাঙ্গনার পিতা। আবার এতো সবকিছুর মাঝেও তিনি পিতামাতার স্নেহের খোকা, দ্বায়িত্ববান স্বামী এবং মমতায়ভরা পিতা। সর্বপরি একজন ভালো মানুষ। তাই তাঁর জীবনের আদর্শ প্রতিটি পদক্ষেপেই অনুসরণীয় যে কোন মানুষের জন্য।

বঙ্গবন্ধু এক আলোর মশালের নাম

স্কুল জীবনেই নেতৃতের অসামান্য বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। এরপর থেকে ১৯৭৫ সালে ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত টানা ৩৬ বছর রাজনীতির সাথে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন যেমন সাফল্যমণ্ডিত, তেমনি রাজনীতি সতেচন যেকোন মানুষের জন্যই তা পরম অনুসরণীয়। সহজাত সাংগঠনিক দক্ষতা আর আজন্ম মানুষের জন্য মমতার কারণে ছোটবেলাতেই তাঁর মধ্য নেতৃত্বের স্ফুরণ ঘটে। একসময় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন শেষ হয় তাঁর। এরপর ১৯৪৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন মুসলিম লীগে। শুরু হয় সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর পথচলা। সেই বছরই তিনি মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এরপর বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর মাধ্যমেই মূলত তো শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলার গণমানুষের কন্ঠস্বর হয়ে ওঠা শুরু।

এরপর ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ফলে গণমানুষের আরও আপন হওয়ার সুযোগ পান। এরপর ‘৫৪ এর নির্বাচনে জয়লাভ করেন। সামরিক সরকারের চক্রান্তে বারবার কারাবন্দী থাকেন মাসের পর মাসের। কিন্তু শত জুলুম আর নিপীড়নের মাঝেও তাঁর হৃদয়টি থাকে বাংলার মানুষের কাছে। তাই তো ‘৬৬ তে ছয় দফা নামের বাঙালির মুক্তির সনদ রচনা করেন তিনি। সংগঠিত করেন বাঙালিকে মুক্তি সংগ্রামের জন্য। জাগিয়ে তোলেন জনতাকে। সবশেষে ’৭১ এর ৭ই মার্চ ভাষণের মাধ্যমে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। এরপর নয়মাস যুদ্ধের পর রক্তে ভিজে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

যুদ্ধ বিদ্ধস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আবারও দেখতে পায় জাতির পিতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। দীর্ঘদিন পাকিস্থানের কাটানোর পর দেশে ফিরে স্বাধীনতার প্রথম বছরেই প্রণায়ন করেন সংবিধান। অসামান্য সব রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমের মাত্র দুই বছরেই দেশকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনেন। ফলে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, আদর্শ এবং পদক্ষেপ অনুসরণীয় দেশের প্রতিটি রাজনীতিবিদের জন্য, প্রতিটি সচেতন নাগরিকের জন্য!

একজন খাঁটি রাজনৈতিকবিদকে অবশ্যই মানুষের ভালোবাসা পেতে হয়, ভালোবাসতে হয় মানুষকে। এদিক থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় সকলের আদর্শ। তিনি ছিলেন বাংলার মানুষের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু। তাই তো তিনি শুধু বাংলাদেশের স্থপতিই নন, তিনি বঙ্গবন্ধু। ‘৬৬ ছয়দফা, ৭ই মার্চের ভাষণ সহ তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষের তাঁর মমতার অসামান্য নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। মুক্তির সনদ ছয়দফার সবগুলো দাবিই ছিলো, গণমানুষের জীবনমান উন্নয়নের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ৭ই মার্চের ভাষণে আমরা শুনতে পাই বজ্রকন্ঠের সেই বাণী, যেখানে বঙ্গবন্ধু বলছেন,

যেন আমার মানুষেরা কষ্ট না পায়।

এখানে তিনি বাংলার মানুষও বলতে পারতেন। কিন্তু মানবিক মমতা তাঁকে পিতার আসন দিয়েছে স্বাধীনতার অনেক আগেই।

মুক্তিযুদ্ধে যখন ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, তখন জীবিত থেকেও অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো প্রায় চার লাখ মা বোনের জীবন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন, ১০ ই জানুয়ারির তাই বঙ্গবন্ধুর বুক চিরে বেরিয়ে আসে গভীর হাহাকার,

ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও- শেখ মুজিবুর রহমান। আর ঠিকানা লেখ ধানমণ্ডি বত্রিশ…। মুক্তিযুদ্ধে আমার মেয়েরা যা দিয়েছে সেই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করব?

বঙ্গবন্ধুর বাণী

এমনই এক মানবিকতা সম্পন্ন মহান মানুষের চেতনা আমাদের শেখায় কী করে মানুষকে ভালোবাসতে হয়। বঙ্গবন্ধু মানুষকে ভালোবেসে ছিলেন। তাই তো তার একটিমাত্র কথায় বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে খালি হাতে জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক শক্তি পাকিস্থানি নরপিশাচদের বিরুদ্ধে। তিনি বলতেন,

“আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দূর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালবাসি।”

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে অসাধারণ দিকটি সম্ভবত তাঁর ব্যক্তিত্ব। যতোটা কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন, কঠিনও হতে পারতেন ততখানি। সাহসিকতার যেন এক মূর্তপ্রতিক। বছরের পর বছরে জেলে বন্দী করে তাঁকে পাকিস্তানি সরকার ভেঙে ফেলতে পারেনি। যেখানে দানব পাকিস্তানি সরকার তাকে অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী করে মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন করা সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র করেছে সেখানে তিনি থেকেছেন অবিচল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

“যতই কষ্টের ভিতর আমাকে রাখুক না কেন, দুঃখ আমি পাব না। … … … এরা মনে করেছে বন্ধু শামসুল হককে (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক) জেলে দিয়ে যেমন পাগল করে ফেলেছিল। আমাকেও একলা একলা জেলে রেখে পাগল করে দিতে পারবে। আমাকে যারা পাগল করতে চায় তাদের নিজেদেরই পাগল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।”

তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধুর্য দিয়ে তিনি শুধু বাঙালী নয়, জয় করেছেন সারা পৃথিবীর হৃদয়। মুক্তিযুদ্ধে যেখানে মুসলিম বিশ্ব প্রতিকূল অবস্থানে ছিলো, সেই মুসলিম বিশ্বের সংগঠন ওআইসিতে যোগ দিয়ে তিনি আপন করে নেন। মুসলিম বিশ্বের সম্মেলনে তিনি বলেন,

“পৃথিবী আজ দুইভাগে বিভক্ত। শোষক, আর শোষিত। আমি শোষিতদের পক্ষে।”

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রে তাঁর ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে বলেন,

আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যাক্তিত্বে দিক থেকে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান।

যেখানেই গেছেন, সেখানেই পেয়েছেন এমন অভিব্যাক্তি। বঙ্গবন্ধু মানুষ হিসেবে বেশ রসিকও ছিলেন। ছিলেন দ্বায়িত্ববান স্বামী ও পিতা। পারিবারিক জীবনের শেখ মুজিবুর রহমান আদর্শ প্রতিটি মানুষের। ন্যায় নীতিবান এই মানুষটির পরিচয় তিনি নিজেই দিয়েছেন,

“আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান”।

বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা শিখি, কী করে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কী করে মানুষের কল্যাণ করতে হয়। শিখি পরিবার থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কেমম মানুষ হতে হয়। শিখি মানুষকে ভালোবেসে কীভাবে একটি শান্তি সুখের পৃথিবী গড়ে তোলা যায়। চিন্তা চেতনায় এই মানুষটি সকলের আদর্শ। আমাদের পথচলায় তাই তো বঙ্গবন্ধু এক আলোর মশালের নাম।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved