কম্পিউটারের কীবোর্ড দেখে আমার বা অনেকের মতো আপনার মনেও হয়ত প্রশ্নটা জেগেছে। বর্ণমালা ক্রম অনুযায়ী না সাজিয়ে কীবোর্ডের অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো কেন থাকে?

বর্তমানে আমরা সবাই কম্পিউটার কীবোর্ডের সাথে সাথে পরিচিত। এমনকি কম্পিউটার না থাকলেই এই স্মার্টফোনের কল্যাণে এই লে-আউট আমরা কমবেশি সবাই দেখেছি। এই কীবোর্ডের উপরের সারীর ছয়টা অক্ষরকে নিলে পাওয়া যায় QWERTY. এজন্য এই কীবোর্ডকে QWERTY কীবোর্ড বলে নাম দেওয়া হয়েছে।

যাইহোক, কীবোর্ডের নাম কীভাবে পাওয়া গেল সেটা না হয় জানলাম। এবার চলুন মূল প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। কেন কীবোর্ডের অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো থাকে?

যে কারণে কীবোর্ডের অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে থাকে

শুরুর কথা

সালটা ১৮৬৮। ক্রিস্টোফার ল্যাথাম শোলস সর্বপ্রথম তার টাইপরাইটার মেশিনটা পেটেন্ট করেন। তখনকার সময় এটা বেশ বড় একটা মেশিন ছিলো সেটা। পিয়ানো সেটের সমান সাইজ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম পেটেন্ট করার আগে শোলস আমার আপনার মতোই স্বাভাবিক চিন্তা করে কীবোর্ডটি সাজিয়েছিলেন। অর্থাৎ মেশিনটাতে বর্ণমালা ক্রম অনুসারেই সাজানো ছিলো অক্ষরগুলো।

সেটা পরিবর্তন করে ফেলেন ১৮৭৩ সালে। শুধু কী বোর্ড লে আউট নয়। মেশিনটির মূল ব্যবস্থাতে পরিবর্তন এনে পেটেন্টের আবেদন করেন। ১৮৭৮ সালে নতুন ভাবে টাইপ রাইটিং মেশিনটার পেটেন্ট পান। এবং অফিশিয়ালভাবে তখন থেকে মূলত QWERTY কী বোর্ডের যাত্রা শুরু হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন ল্যাথাম শোলস মূল লে-আউটকে পরিবর্তন করে এমন বিদঘুটে লে-আউট বেছে নিলেন? পিছনের গল্পটা কী ছিলো?

আমরা যা জানি

কীবোর্ডের অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে থাকে যে কারণে

এ বিষয়ে অনেক তত্ত্ব রয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব হচ্ছে, লেখার গতি কমানো তত্ত্ব। যেখানে বলা হয়, লেখার গতি কমিয়ে দেওয়ার জন্য QWERTY কীবোর্ড এর প্রবর্তন করেন শোলস। পাশাপাশি T-H বা H-E অক্ষরগুলো পাশাপাশি থাকলে টাইপরাইটের মেকানিজমে দ্রুত সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই যান্ত্রিক ত্রুটি কমানোর জন্য বর্ণমালা ক্রম বাদ দিয়ে এই লে-আউট তৈরী করেন শোলস।

তত্ত্বটা বেশ চটকদার হওয়ায় প্রচুর মানুষ এটা বিশ্বাস করে। ফেসবুকের কল্যাণে এই তথ্য দিয়ে বানানো ছবি ছড়িয়ে পড়ায়, আমাদের দেশেরও অনেকে গল্পটি জানেন। এবং মানেন।

আরও পড়তে পারেনঃ টাইপরাইটার – বিস্ময়কর লেখার যন্ত্রটি যেভাবে কাজ করত

যাইহোক, দেড়শো বছরেরও বেশি সময় আগের একটি ঘটনা কেন ঘটেছিল সেটা বের করা একটু কঠিনই বটে। তাই, উত্তর খুঁজে বের করতে জাপানের কিয়োটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন গবেষক শুরু করে অনুসন্ধান। তাদের গবেষণায় উঠে আসে বিস্ময়কর তথ্য।

কীবোর্ডে অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে থাকার পিছনের কারণ

২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁদের সেই গবেষণাপত্রে তাঁরা বলেন যে, গতি কমানোর জন্য তো নয়ই বরং গতি বাড়ানোর জন্য তৈরী করা নতুন এলোমেলো এই লেআউটটি। শোলস এর সময়কার ইতিহাস সেই কথাই বলে।

ক্রিস্টোফার শোলসের টাইপরাইটিং মেশিনের প্রথম কাস্টমারদের একটি ছিলো শিকাগোর পোর্টার্স টেলিগ্রাফ কলেজ। কলেজের অধ্যাক্ষ এডওয়ার্ড পোর্টার শোলসের কাছে এমন একটি মেশিন চেয়েছিলেন, যার সাহায্য টেলিগ্রাফ অপারেটররা মোর্স কোডে যে মেসেজ পেয়েছে সেটা খুব সহজেই লিখতে পারে।

পরে শোলস আমেরিকার টেলিগ্রাফ নিয়ে কাজ করা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথেও দেখা করেন। এবং প্রতিটি মিটিং পর কীবোর্ড লেআউটের সামান্য করে পরিবর্তন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিলো, মোর্স কোডে আসা মেসেজের গতির সাথে টেলিগ্রাফ অপারেটরদের মেসেজ লেখার গতি সমান করা। এজন্য তাই কী বোর্ডের লে-আউটটি সরাসরি টেলিগ্রাফ অপারেটরদের কাছে থেকেও আসতে পারে।

কীবোর্ডের যান্ত্রিক ত্রুটি কমানোর জন্য যে অক্ষর এলোমেলো করা হয়েছে, সেই যুক্তিটিও ধোপে টেকে না। কারণ, ইংরেজি শব্দ লিখতে গেলে E-R এবং R-E অক্ষর দুইটা প্রচুর ব্যবহার হয় একসাথে। QWERTY কীবোর্ডে আমরা দেখতে পাই এই অক্ষর দুইটি পাশাপাশি রয়েছে। তাই যান্ত্রিক ত্রুটি কমানোই যদি উদ্দেশ্য হতো তাহলে ক্রিস্টেফার শোলস নিশ্চয়ই এই লেআউটি নিয়ে আসতেন না।

যেভাবে সার্বজনীন হলো লেআউটটি

তবে, একথাও বলার উপায় নেই যে QWERTY কীবোর্ড শতভাগ নিখুঁত। এতে সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে। তা সত্ত্বেও একথা সত্য যে, বর্তমানে এটি একটি সার্বজনীন লেআউট। পৃথিবীর সব কম্পিউটার কীবোর্ড তৈরী হয় এই লেআউটকে ভিত্তি করে। কীভাবে সেটা হলো?

১৮৭৩ সালে, শোলস তার টাইপরাইটার তৈরির জন্য বন্দুক প্রস্তুতকারী রেমিংটনের সাথে চুক্তি করেন এই লেআউট ব্যবহার করে টাইপরাইটার তৈরী করে দেওয়ার। এবং বড় আকারে উৎপাদন শুরু করার আগে পেটেন্ট জমা দেওয়া হয়। এবং ১৮৭৮ সালে অবশেষে পেটেন্টটি চুক্তি অনুসারে রেমিংটন কোম্পানির নামে দেওয়া হয়।

আরও পড়তে পারেনঃ পেরিস্কোপ : একটি সাধারণ কিন্তু বিস্ময়কর আবিষ্কার

যাইহোক, রেমিংটনের সাথে চুক্তি হওয়ায় শোসল তার টাইপরাইটারের বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারী পেয়ে যান। ১৮৯০ সালে শুধুমাত্র রেমিংটন কোম্পানিতেই QWERTY লে-আউটযুক্ত টাইপরাইটারের সংখ্যা ছিলো ১ লাখের বেশি।

১৮৯৩ সালে টাইপরাইটার প্রস্তুতকারী পাঁচটি বড় বড় প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে গঠিত ইউনিয়ন টাইপরাইটার কোম্পানি। যেহেতু ততদিনে প্রচুর মানুষ QWERTY লেআউটে অভ্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো, তাই তাঁরা সার্বজনীনভাবে কীবোর্ডের লেআউট হিসেবে এটাকেই নির্বাচন করেন।

কারণ, সেসময় নতুন কোন লেআউটকে বাজারে নিয়ে আসলে মানুষকে নতুন করে শিখতে হতো। ফলে সেটার বিক্রিও কমে যেত। তাই, অন্য সব নির্মাতা কোম্পানিরাও কীবোর্ড লেআউট হিসেবে QWERTY কে ব্যবহার করে আসছেন।

শেষ কথা

যাইহোক, রেমিংটনের কাছে তার পেটেন্ট বিক্রি করার পরেও শোলস তার টাইপরাইটার ডিজাইন এবং কী লেআউটের উন্নতির জন্য কাজ চালিয়ে যান। কারণ মনীর ভিতর কোথাও তিনি QWERTY কীবোর্ড নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না।

১৮৯০ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে, তিনি সম্পূর্ণ আলাদা লে-আউট সহ একটি টাইপরাইটারের জন্য আরেকটি পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সেই লেআউটটি ততদিনে সফল হওয়ার পথ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলো।

কীবোর্ডের অক্ষরগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো কেন থাকে তা আশা করি বুঝতে পেরেছেন। লেখাটি নিয়ে আপনার ভালোলাগা, মন্দলাগা অথবা যে কোন মতামত জানাতে পারেন কমেন্ট বক্সে। আর ভালো লাগলে অবশ্যই লেখাটি বন্ধুদের শেয়ার করে নিতে ভুলবেন না।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved