পেরিস্কোপ : একটি সাধারণ কিন্তু বিস্ময়কর আবিষ্কার

পেরিস্কোপ হচ্ছে একটি দেখার যন্ত্র। যার সাহায্য ভিন্ন কোণে, মাথা না সরিয়ে চারপাশ দেখা যায়। সহজ ভাষায় বললে, আপনি যদি আপনার অবস্থা থেকে কিছুটা উঁচুতে গিয়ে কোনকিছু দেখতে চান; কিংবা ডানে বামে না সরে ডানেবামের দৃশ্য দেখতে চান; অথবা, না ঘুরে আপনার পিছনের কোন দৃশ্য দেখতে চান, তাহলে সেই কাজে আপনার একনিষ্ঠ সহায়তাকারী হবে পেরিস্কোপ।

যে কোন দৃষ্টিকোন থেকেই পেরিস্কোপ একটি অসামান্য আবিষ্কার। পেরিস্কোপ কি সেটা জানা থাকুক বা না থাকুক, এ সম্পর্কিত আপনার কৌতুহল কিছুটা হলেও নিবৃত্ত হতে যাচ্ছে এই লেখায় আশাকরি। লেখাটি কেমন লাগলো পড়া শেষে তা জানিয়ে কমেন্ট বক্সে আপনার মতামতটি লিখে দিবেন। আপনার মন্তব্য আমাদের জন্য দারুণ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

পেরিস্কোপ কি, কীভাবে কাজ করে, এর আবিষ্কার ও ব্যবহার

পেরিস্কোপ কী

পেরিস্কোপের গঠনঃ কীভাবে কাজ করে পেরিস্কোপ

অনেকটা Z (Z এর মতো মাঝখানে অংশটা হেলানো নয়, একদম সোজা থাকতে হবে) আকৃতির টিউব বা নল, সাথে দুই টুকরো আয়না। এটুকুই একটা সাধারণ পেরিস্কোপ তৈরীর উপাদান। Z আকৃতির নলের বাঁকা দুই কোনায় দুইটি আয়না ৪৫ ডিগ্রী কোণে বসিয়ে তৈরী করা হয় টেলিস্কোপ। তবে, এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য এতে লেন্স এবং প্রিজমেরও ব্যবহার করা হয় অনেক সময়।

একদম সহজ তাই না? আসলেই পেরিস্কোপ তৈরী করা সহজ। আপনি চাইলে নিজের বাড়িতে বসেই এটা তৈরী করে ফেলতে পারবেন। কীভাবে তৈরী করবেন তা নিয়ে ইন্টারনেটে প্রচুর লেখা এবং টিউটোরিয়াল আছে। আপনাদের আগ্রহ থাকলে আমরাও এনিয়ে একটা বিস্তারিত একটা টিউটোরিয়াল লিখবো, ইনশাআল্লাহ্‌। তাই, এ নিয়ে আজকে আর কথা বাড়াচ্ছি না।

আরও পড়তে পারেনঃ অপারেটিং সিস্টেম কী? অপারেটিং সিস্টেম এর কাজ

পেরিস্কোপের গঠন তো জানলেন। এবার কীভাবে কাজ করে পেরিস্কোপ সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আমরা জানি, কোন বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়লে তখন আমরা সেই বস্তুটাক দেখতে পাই। পাশাপাশি এটাও জানি যে আলো সরল পথে চলে।

তাই স্বাভাবিক অবস্থায় কোন বস্তু আমাদের চোখের সামনে না থাকলে সেটাকে দেখতে পাই না। অন্যভাবে বললে, বস্তুর দিকে না তাকালে আমরা সেটাকে দেখতে পাই না। বস্তু এবং আমাদের চোখের মধ্য কোন প্রতিবন্ধক থাকলেও সেটাকে আমরা দেখতে পাই না, আলো সরল পথে চলার কারণে।

পেরিস্কোপ যেভাবে কাজ করে

পেরিস্কোপের সাহায্য মূলত বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। যে কাজটি করে ৪৫ ডিগ্রী কোণে বসানো আয়না দুটো। প্রথমে বস্তু থেকে আলো পেরিস্কোপের খোলা অংশ দিয়ে এসে ৪৫ ডিগ্রী কোণে রাখা একটা আয়নায় পড়ে। সেই আয়নাটি আগত আলোক রশ্মিকে সোজা ৯০ ডিগ্রী কোণে প্রতিফলিত করে দেয়।

এর ফলে এবার এই প্রতিফলিত আলোকরশ্মীটি এসে পড়ে দ্বিতীয় আয়নাটির উপরে। দ্বিতীয় আয়নাটিও যেহেতু ৪৫ ডিগ্রী কোণে বসানো, তাই সেও আলোকরশ্মিটিকে ৯০ ডিগ্রী কোনে প্রতিফলিত করে টিউবের আরেক মাথা দিয়ে বের করে দেয়। টিউবের এই মাথাতেই থাকে আমাদের চোখ। তাই আলোক রশ্মীটিকে এবার আমাদের চোখে এসে পড়ে। এভাবেই পেরিস্কোপেরে সাহায্য আলোক রশ্মীর দিক ঘুরিয়ে নিয়ে দৃষ্টির অগোচরে থাকা জিনিস দেখতে পারি।

পেরিস্কোপের আবিষ্কারঃ

সর্বপ্রথম ১৬৪৭ সালে ইয়োহানেস হেভেলিয়াস নতার একটি লেখায় টেলিস্কোপের বর্ণনা দেন। তিনি অবশ্য সে সময় পেরিস্কোপ শব্দটি ব্যবহার করেন নি। তার বর্ণনায় পেরিস্কোপের মতো যন্ত্রটি নামকরণ করেছিলেন পোলমোস্কোপ।

তবে, হাতেকলমে টেলিস্কোপ আবিষ্কারের কৃতিত্বটি দেওয়া হয় ফ্রেঞ্চ রসায়নবিদ এবং আবিষ্কারক হিপ্পোলাইট মারি-ডেভি কে। যিনি ১৮৪৫ সালে প্রথমবারের মতো নৌ-পেরিস্কোপ তৈরী করেন। পরবর্তীতে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় স্যার হাওয়ার্ড গ্রাব পেরিস্কোপকে আরও উন্নত এবং কার্যকর করার ব্যাপারে কাজ করেন।

পেরিস্কোপ আবিষ্কারের আগে এনিয়ে অনেক লেখক এবং সাহিত্যিক তাদের রচনায় পেরিস্কোপের ব্যাবহার এবং গঠন নিয়ে লিখে গেছেন। এদেরর মধ্য অন্যতম একজন হচ্ছেন আমিরিকান সাহিত্যিক মর্গান রবার্টসন

ইয়োহানেস হেভেলিয়াস সেসময় পেটেন্ট নিয়ে মাথা ঘামালেও রবার্টসন কিন্তু সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। পেরিস্কোপের পেটেন্ট আদায় করার জন্য রীতিমত আইনি লড়াই করেন। শেষ পর্যন্ত পেটেন্ট পান নি, তবে স্বঘোষিত পেরিস্কোপের আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জাগয়া করে নিয়েছেন মর্গান রবার্টসন।

পেরিস্কোপের যতো ব্যবহারঃ

পেরিস্কোপ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সামরিক কাজে এবং জলযানে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় প্রথমবারের এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সেসময় পদাতিক সৈন্যরা তাদের পরীখার ভেতরে থেকে উপরে শত্রুপক্ষের গতিবিধি দেখত পেরিস্কোপের সাহায্য।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাইফেলের সাথে পেরিস্কোপের সংযুক্তি ঘটিয়ে পেরিস্কোপ-রাইফেলের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার সাহায্য পরীখার ভেতর থেকেই শত্রুর উপর গুলি বর্ষণ করা সম্ভব হতো।

আরও পড়তে পারেনঃ ক্লাউড কম্পিউটিং কী? এ সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার

ট্যাংক এবং অন্যান্য আবদ্ধ যুদ্ধযানের ভিতর থেকে বাইরের অবস্থা দেখার জন্য পেরিস্কোপ একটি আদর্শ এবং বহুল ব্যবহৃত যন্ত্র। তবে এসব কাজে যে পেরিস্কোপ ব্যবহার করা হয় সেগুলো ৩৬০ ডিগ্রী কোণে ঘুরতে পারে। অর্থাৎ এই পেরিস্কোপগুলো দিয়ে শুধু একদিকের দৃশ্য নয় বরং সামনে পিছনে চারদিকের দৃশ্যই দেখা যায়। ১৯৩৬ সালে রুডলফ গুন্ডলাচ এই বিশেষ পেরিস্কোপ তৈরী করেন এবং এর পেটেন্ট নেন।

পেরিস্কোপের ব্যবহার

তবে সর্বপ্রথম পেরিস্কোপ ব্যবহৃত হয় সাবমেরিনে বা ডুবজাহাজে। মূলত ডুবজাহাজ থেকে বাইরের অবস্থা দেখার লক্ষ্যেই মারি-ডেভি তার নৌ-পেরিস্কোপটি উদ্ভাবন করেন। পেরিস্কোপ ডুবজাহাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এখনও। প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে বর্তমান সময়ে পেরিস্কোপ হয়ে উঠেছে আরও বেশি কার্যকর।

পেরিস্কোপ যে শুধুমাত্র সামরিক কাজে বা সাব মেরিনেই ব্যবহৃত হয় এমন কিন্তু হয়। গবেষণা, অভিযান কিংবা অনুসন্ধানেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। সেসব নিয়ে নাহয় আরেকদিন আলোচনা করা যাবে।

পেরিস্কোপ খুব সাধারণ একটা আবিষ্কার হলেও এর হাত ধরেই সম্ভব হয়েছিলো ডুবজাহাজ নিয়ে সাগরের নিচে অভিযানের। পেরিস্কোপ ছাড়া ডুবজাহাজের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সব ভালো আবিষ্কারের মতো এটাও ব্যবহৃত হয়েছে মন্দকাজে। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে পেরিস্কোপের ভালো কাজে ব্যবহারের দিকটাই বেশি ভারী।

শেয়ার করে নিনঃ

Leave a Reply

This Post Has 2 Comments

  1. মৃদুল

    ভালো