বিশ্বব্রহ্মান্ডের আনাচে কানাচে প্রতি পরতে লুকিয়ে আছে রহস্য। যার খুব সামান্যই আমরা জেনেছি। প্রকৃতির রহস্যের যেমন কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই, তেমনি আমাদের জানবার কৌতুহলেরও কোনো কমতি নেই। সময় যত গড়াচ্ছে, মানুষও তার সাধ্যমত কিংবা কখনো সাধ্যের বাইরে গিয়ে, রহস্যের বৃত্ত ভেঙেই চলছে।

আজ যে বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব, তা বিজ্ঞানের জন্য এক অনন্ত বিস্ময়!

আপনি জেনে অবাক হবেন যে, “পৃথিবীর ভূত্বক কেন্দ্রের চেয়ে আড়াই বছরের পুরোনো।” এর অর্থ হল যে আমাদের গ্রহের কেন্দ্র (অভ্যন্তর) তার পৃষ্ঠের (বহিস্তরের) তুলনায় আড়াই বছরের (২.৫) ছোট।

কি অবাক লাগছে, তাই তো? আমি যা বললাম তা গোলমেলে ঠেকছে? অথবা, আমাকে উন্মাদ ভাবছেন?

পৃথিবীর ভূত্বক, কেন্দ্র এবং আইনস্টাইন

যাই দ্বিধা লাগুক না কেনো, উপরোক্ত বাক্যটি আমার নয়, এমনকি কোন মনগড়া কথাও নয়। এই বাক্যর পিছে যে তত্ত্বটি খুঁটি হিসেবে কাজ করছে, উহার জনক আমাদের সকলের পরিচিত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তিতে, পদার্থবিজ্ঞানীরা গণনা করেছেন যে, পৃথিবীর কেন্দ্রটি তার পৃষ্ঠের চেয়ে আড়াই বছর ছোট, সাধারণ আপেক্ষিকতা দ্বারা বর্ণিত মাধ্যাকর্ষণ প্রভাবের জন্য। এই তত্ত্বের সুস্পষ্ট ব্যবহার রয়েছে মহাকাশের জিপিএস স্যাটেলাইটে।

তবে সেখানে সময়ের পার্থক্য খুবই নগণ্য, এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মত সময়। একদিন কিংবা একবছরের মত দীর্ঘ সময়ের মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। আর এজন্যেই স্যাটেলাইটের সাথে আমাদের পৃথিবীর সময়কে মিলিয়ে রাখার জন্যে বিজ্ঞানীরা একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করেন, যাতে খুব ক্ষুদ্র সময় ব্যবধানের সমস্যাটাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

পৃথিবীর ভূত্বক তার কেন্দ্রের চেয়ে আড়াই বছরের পুরোনো

কৌতুহলের প্রারম্ভভিক ইতিবৃত্ত

১৯৬০ সালে রিচার্ড ফাইনম্যান দাবি করেছিলেন যে পৃথিবীর কেন্দ্র এবং পৃষ্ঠের মধ্যে বয়সের পার্থক্য প্রায় এক বা দুই দিন। তখন এই বিষয়টাকে কেউ গুরত্ব দেয় নি। সেজন্যে দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনাও হয় নি।

তবে সম্প্রতি ডেনমার্কের আরহুস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উলরিক উগেরহাজ এবং তার সহকর্মীরা পৃথিবী নিয়ে পরীক্ষাকালে লক্ষ্য করেন, ফাইনম্যান কথিত যে দাবিটি করেছিলেন, তা অনেকবেশি সুস্পষ্ট। এবং সেই দলটি এই বিষয় নিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে

আরও পড়তে পারেনঃ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে আনতে পারে বিপ্লব

আইনস্টাইনের তত্ত্ব

আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি বলে যে, স্পেসের বিভিন্ন স্থানে সময় বিভিন্ন রকমের। যেখানে মহাকর্ষ বল এর মান বেশি, অর্থাৎ যেসকল স্থান বা গ্রহের ভর বেশি, সেখানে সময়ের গতি ধীর। আর যেসকল স্থানে তুলনামূলক ভর কম সেখানে সময় দ্রুত চলে। এই প্রক্রিয়াটি কাল দীর্ঘায়ণ (Time dilation) নামে পরিচিত।

পরীক্ষালব্ধ ফলাফল

আইনস্টাইনের সমীকরণের সাহায্যে হিসেব করে দেখা যায় কাল দীর্ঘায়ন ধারনা অনুযায়ী 3×10-8 মানের একটি গুণক পাওয়া যায়। যার অর্থ পৃথিবীর প্রতি ১ সেকেন্ডের সময়ের জন্যে পৃথিবীর ভুত্বকের উপরিভাগ এবং এর কেন্দ্রের মাঝে অতিক্ষুদ্র সময়ের পার্থক্য ঘটে।

যা আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য বলে মনে হলেও, পৃথিবীর বয়সের সাপেক্ষে এই মানটা পৃথিবী পৃষ্ঠ এবং এর কেন্দ্রের মাঝে বড়সড় সময়ের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে, যার মান আড়াই বছর।

এই হিসাবটি করার সময় পৃথিবীর সকল স্থানের ঘনত্ব সমসত্ব আকারে ধরে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু আমরা এটা জানি যে, পৃথিবীর কেন্দ্রের ঘনত্ব এর উপরিভাগের চেয়ে অনেক বেশি। তাই উলরিক উগেরহাজের দলটি অন্য একটি বাস্তব সম্মত মডেলের মাধ্যমে হিসেব করেও দেখতে পান সময় ব্যবথানের মান আড়াই বছর-ই আসে।

মতামত

হতে পারে তাদের এই ধারণাটি সম্পূর্ণ প্রকারে সঠিক নয়। তবে আজ অবধি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্বের বিরুদ্ধে তোলা সকল পরীক্ষাতেই আইনস্টাইন এখনো নির্ভুল প্রমাণিত রয়েছেন। সুতরাং তার তত্ত্ব অবলম্বনে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল নেহাৎ উড়িয়ে দেওয়ার মত, এমনটাও বলা যাচ্ছে না।

একই পদ্ধতি ব্যবহার করে জানা যায় যে, সূর্যের কেন্দ্র এর উপরিভাগের চেয়ে চল্লিশ হাজার (৪০,০০০) বছরের ছোট। সূর্যের ক্ষেত্রে এই মানটি এত বৃহৎ হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে সূর্যের বৃহৎ আকৃতি যা, পৃথিবীর তুলনায় অনেক বেশি। তাই পার্থক্যর পরিমাণ টাও আপেক্ষিক অনুপাতে দীর্ঘায়িত হয়েছে।

আরও পড়তে পারেনঃ সূর্যের বয়স কতো? কীভাবে জানলাম সূর্যের বয়স?

আশা করি, পৃথিবীর ভূত্বক ও কেন্দ্রের বয়স নিয়ে আজকের বিজ্ঞান বিষয়ক এই লেখাটি আপনাদের ভালো লেগেছে। এবং আপনাদের কৌতুহলকে আরো উদ্দীপ্ত করেছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তবেই আমার সার্থকতা।

আপনাদের প্রিয়/ আগ্রহের কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে কমেন্ট বক্সে লিখে আমাদের জানান, আমরা চেষ্টা করব সেই বিষয়গুলোকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। ভালো লেগে থাকলে লেখাটি শেয়ার করতে ভুলবেন না!


মোঃ মারুফ আহমেদ

বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে বিষয়ে স্নাতক করছি। ভালো মানুষ হবার প্রচন্ড ইচ্ছে বুকে নিয়েই অনাগত পৃথিবীতে নিজের যাত্রা অব্যাহত রেখেছি।

2 Comments

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন কী রকম? - কেন্দ্রবাংলা · November 26, 2022 at 9:14 pm

[…] আরও পড়তে পারেনঃ পৃথিবীর ভূত্বক যেভাবে কেন্দ্রের চেয়… […]

বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি - কেন্দ্রবাংলা · November 27, 2022 at 11:29 am

[…] আরও পড়তে পারেনঃ পৃথিবীর ভূত্বক যেভাবে কেন্দ্রের চেয়… […]

  • Leave a Reply

    Avatar placeholder

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    2023 © KendroBangla | All Rights Reserved