আপনি যদি আইফোন ১২ কিংবা পিক্সেল ৫ এর মতো হাইএন্ড ডিভাইসগুলোর ব্যাপারে কৌতুহলী হন; কিংবা নতুন যে কোন প্রযুক্তি নিয়ে সবসময় খোঁজ খবর রাখেন তাহলে “ই-সিম” নিশ্চয়ই আপনার পরিচিত শব্দ। ই-সিম একদম নতুন প্রযুক্তি না হলেও সম্প্রতি হাইএন্ড এবং পপুলার কিছু ডিভাইসে এই ফিচারটি যুক্ত করা হয়েছে। তাই, আমার মতো আপনিও যদি ই-সিম কী তা জানতে আগ্রহী হন; তবে এই লেখাটি আপনার জন্যই।

কোন ডিজিটাল ডিভাইসে ওয়্যারলেস সংযোগের জন্য সিমকার্ড এখনও একটা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। গতো একদশকের বেশি সময় ধরে বেশিরভাগ মানুষ একাধিক সিমকার্ড ব্যবহার করা যায় এমন ডিভাইস ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

কিন্তু স্মার্টফোন বা স্মার্টওয়াচের মতো হ্যান্ডি ডিভাইসে এক মিলিমিটার জায়গাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দুইটা 2FF সাইযের সিমকার্ডের জন্য জায়গা রাখা তাই একধরণের অপচয়। তাই, চাহিদা পূরণ করতে সিমকার্ডের গতো একদশকে সিমকার্ডের সাইযে এসেছে পরিবর্তন।

মিনি সিমকার্ডের চেয়ে মাইক্রো কিংবা ন্যানো সিমকার্ড ব্যবহার করতেই আমরা এখন অভ্যাস্ত। এরপরও দুইটা ন্যানো সিমের জন্য স্মার্টফোনে বা স্মার্টওয়াচে যতোটুকু জায়গা প্রয়োজন হয়, সেটা কমিয়ে আনতে পারলে জায়গাটা আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকে। এই চিন্তা থেকে মূলত ই-সিমের আবির্ভাব।

শুধু ডিভাইস নির্মাতাদের জন্যই নয়, ব্যবহারকারীদের জন্যও ই-সিম নানা সুবিধা বয়ে আনবে। তাই, সাধারণ সিমকার্ডের যুগের সমাপ্তি টেনে ই-সিম যে আগামী দিনে ভবিষ্যৎ হতে যাচ্ছে, একথা জোর দিয়েই বলা যায়। চলুন এবার জেনে নিই, সাধারণ সিমকার্ডের চেয়ে ই-সিম কতোটুকু সুবিধার বা ই-সিম কী করে কাজ করে।

ই-সিম কী? কীভাবে কাজ করে এবং এর সুবিধা-অসুবিধা

ই-সিম কী

ই-সিম কী

ই-সিম (eSIM) হচ্ছে এক ধরণের উন্নত প্রযুক্তির সিম। যার পূর্ণ রূপ এমবেডেড সাবস্ক্রাইবার আইডেনটিটি মডিউল বা এমবেডেড সিম। এমবেডেড শব্দটির সুন্দর কোন বাংলা শব্দ আমি খুঁজে পাইনি। এই লেখায় আমরা তাই এমবেডেড শব্দটিই ব্যবহার করবো।

এমবেডেড সিম মূলত প্রচলিত সিমকার্ডের কাজটিই করে। সেই অর্থে একে প্রচলিত সিমকার্ডের প্রতিস্থাপক বলা যায়। তবে, প্রচলিত সিমকার্ডের মতো এমবেডেড সিম আলাদা করে খোলা বা লাগানোর কোন সুযোগ নেই।

এটি প্রচলিত ব্যবহৃত ন্যানো সিমের চেয়েও অনেক ছোট। একধরণের কানেক্টিং চিপ হিসেবে এটি ডিভাইসের মাদারবোর্ডে সংযুক্ত করা হয়; ডিভাইস তৈরীর সময়ই। তাই এটাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল সিমকার্ডও বলা যায়।

এতটুকু পড়ার পরে নাম্বার চেঞ্জ বা একাধিক কোম্পানির সিমকার্ড ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন কি? হ্যাঁ একথা সত্য যে, সামনের দিনগুলোতে ই-সিম যুক্ত ডিভাইসে সাধারণ সিমকার্ড ব্যবহারের মতো কোন স্লট থাকবে না। কিন্তু সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তারও অবকাশ নেই।

কারণ, সিমকার্ড পরিবর্তন করা না গেলেও আপনি ই-সিমের সাহায্যই অপারেটর এবং নাম্বার পরিবর্তন করতে পারবেন। একই সাথে একাধিক নাম্বার অর্থাৎ ডুয়েল সিম ব্যবহারের কাজটিও করতে পারবেন। এবং সেটা এখনকার চেয়ে আরও সহজে করতে পারবেন।

তুলনামূলক সিমকার্ড ও ই-সিম কার্ডের সাইয

ই-সিম ফিজিক্যালি সাধারণ সিমকার্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হলেও প্রযুক্তিগত দিক থেকে দুইটা কিন্তু একইভাবে কাজ করে। অর্থাৎ সাধারণ সিমকার্ডের মতো একই জিএসএম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই ই-সিম কাজ করে।

আপনি কি এখন ই-সিম ব্যবহার করতে পারবেন?

আপনি যদি বাংলাদেশে থাকেন তাহলে এই মুহূর্তে আপনি ই-সিম ব্যবহার করতে পারবেন না। কারণ, ই-সিম ব্যবহারের জন্য যেমন ই-সিম যুক্ত ডিভাইস প্রয়োজন। তেমনি প্রয়োজন সিম কোম্পানির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা।

আমাদের জানামতে বাংলাদেশের কোন মোবাইল অপারেটর কোম্পানি এ সেবাটি চালু করে নি। তবে এটিএন্ডটি এবং টি-মোবাইলের মতো বেশ কিছু মোবাইল অপারেটর কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো ১২০ টিরও বেশি দেশে ই-সিম সেবা চালু করেছে।

তাই, আপনি সেসব দেশে এধরণের কোন অপারেটরের গ্রাহক হলে এবং আপনার কাছে ই-সিম সাপোর্টেড ডিভাইস থাকলে; আপনি এই মুহূর্তে ই-সিম ব্যবহার করতে পারবেন।

বর্তমানে ই-সিম যেসব ডিভাইসে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে; সেগুলোতে ই-সিমের পাশাপাশি সাধারণ সিমকার্ডের জন্য স্লট রয়েছে। তাই, মোবাইল অপারেটরের সক্ষমতা না থাকলেও আপনি আপনার ডিভাইসে সাধারণ সিমকার্ড ব্যবহার করতে পারবেন।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ই-সিম সাপোর্টেড যে সব ডিভাইস পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো হলোঃ

আইফোন ১২ এর সকল ভার্সন, আইফোন ১১, এক্সএস, এক্সআর এবং এসই স্মার্টফোন।
অ্যান্ড্রয়েডের মধ্য গুগল পিক্সেল ২ থেকে পিক্সেল ৪এ ৫জি, সামস্যাঙ গ্যালাক্সি এস২০, এস২০ এফই, গ্যালাক্সি ফোল্ড এবং জি ফ্লিপ, এবং নোট ১০ এর সকল ভার্স্ন ই-সিম সাপোর্ট করে। এছাড়াও দ্য মটো রেজর ডুয়ো ফোনেও ই-সিম ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

স্মার্টফোনের বাইরে বর্তমানে অ্যাপল ওয়াচ, স্যামসাঙ গ্যালাক্সি ওয়াচ এবং হুয়াওয়ে ওয়াচ ই-সিম সাপোর্ট করে। পাশাপাশি উইন্ডোজ ১০ চালিত বেশকিছু ল্যাপটপেও রয়েছে ই-সিম ব্যবহারের ব্যবস্থা।

যেভাবে ই-সিম ব্যবহার করবেনঃ

আপনি যদি ই-সিম সেবা দেয় এমন কোন মোবাইল অপারেটরের গ্রাহক হন এবং আপনার কাছে একটি ই-সিম সাপোর্টেড ডিভাইস থাকে; তাহলে আপনি খুব সহজেই ই-সিম ব্যবহার করতে পারবেন।

যেহেতু ই-সিমের ক্ষেত্রে সিমকার্ড ফিজিক্যালি ইনসার্ট করার কোন সুযোগ নেই, তাই ডিভাইসে সিমকার্ড অ্যাক্টিভের পুরো কাজটি করতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে। তবে ভাবনার কিছু নেই। এজন্য আপনার বিশেষ কোন সফটওয়্যার ইন্সটল করা বা বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হতে হবে না।

যেসব ডিভাইস ই-সিম সাপোর্ট করে সেসব ডিভাইসে ই-সিম সেটাপ করার সফটওয়্যার দিয়ে দেওয়া থাকে। ফলে সেটিং থেকে খুব সহজেই আপনি ই-সিম সেটাপ করে নিতে পারবেন।

ই-সিম অ্যাক্টিভিশন

ডিভাইসে ই-সিম সেটাপ করার পূর্বে আপনাকে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আপনি কোন নাম্বার এবং কোন প্ল্যানে ই-সিম নিতে চান সেটা তাদেরকে জানাতে হবে। এরপর মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ই-সিম অ্যাক্টিভ করার জন্য আপনাকে কিউআর কোড সম্বলিত একটি কার্ড দিবে। এক্ষেত্রে কার্ডের জন্য আপনাকে এক্সট্রা টাকা পেমেন্ট করতে হতেও পারে। এটা সম্পূর্ণই নির্ভর করবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির উপর।

আপনি যখন আপনার ই-সিম অ্যাক্টিভিশনের কার্ড পাবেন, তখন সেটাকে শুধু আপনার ডিভাইসের নির্দিষ্ট সেটিং থেকে স্ক্যান করে নিতে হবে।

এক্ষেত্রে আইফোন থেকে-

  • প্রথমে সেটিংস এ যাবেন।
  • তারপর Cellular (or Mobile Data) অপশনটিতে যাবেন।
  • এবার Add Cellular Plan অপশনটিতে গিয়ে কিউআর কোডটি স্ক্যান করে নিন।

অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে ই-সিম সেটাপ করার জন্য-

  • প্রথমে সেটিংস অপশনে যান।
  • এরপর Network & internet অপশনে যান।
  • এখন Add অপশনটিতে ক্লিক করুন এবং স্ক্রিনে আসা ইন্সট্রাকশন ফলো করুন। এবং Use 2 Number এই অপশনটি সিলেক্ট করুন।

অ্যাপল ওয়াচ বা গ্যালাক্সি ওয়াচে ই-সিম অ্যাক্টিভ করতে পারবেন, ফোনের অ্যাপ থেকেই।

ই-সিমের সুবিধাঃ

ই-সিমের সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হচ্ছে, এটি সত্যিই অনেক ছোট। বর্তমানে প্রচলিত সবচেয়ে ছোট ন্যানো সিমকার্ডের চেয়ে অন্তত ৩গুণ ছোট এই ই-সিম। ন্যানো সিমকার্ড ইনসার্ট করতে যেখানে ১০৮.২৪ বর্গ মিলিমিটার জায়গার প্রয়োজন হয়; সেখানে মাত্র ৩০ বর্গ মিলিমিটার জায়গাতে লাগে ই-সিম এর চিপ বসাতে।

এর ফলে আগের সিম স্লটের জন্য স্মার্টফোনে যে জায়গা রাখতে হতো; সে জায়গাটুকু ব্যবহার করে ফোনের অন্যান্য যন্ত্রাংশের উন্নয়ন করা আরও সহজ হবে। শুধু যে অন্যান্য যন্ত্রাংশের জন্য বাড়তি জায়গা পাওয়া যাবে তাই নয়, এর ফলে বেশি শক্তিশালী ব্যাটারিও ব্যবহার করা সম্ভব হবে। ফোনের ইন্টারনাল ডিজাইনেও আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন।

ই-সিম ফোনের একপাশে বা ধারে যুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। তাই ওয়াটারপ্রুফ বা ডাস্টপ্রুফ ডিভাইসও তৈরী করা যাবে সহজে। এর ফলে এধরণের ডিভাইসের দামও কমে আসবে অনেকটাই। ব্যবহারকারীরাও ই-সিম ব্যবহারে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন

কয়েকটা সিমকার্ড পকেটে নিয়ে ঘোরার প্রয়োজন হবে না। খুঁজতে হবে না সিমকার্ড রাখার ট্রে খোলার জন্য কোন পেপারক্লিপ বা আলপিন।

ই-সিম এর সুবিধা

ই-সিমের অসুবিধাঃ

সুবিধার সাথে অসুবিধার সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য। তাই ই-সিম ব্যবহারেও কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। বিশেষ করে আপনি যখন আপনার মোবাইল ফোন বা ডিভাইসটি চেঞ্জ করবেন; তখন এখনকার মতো সিমকার্ডটা খুলে নতুন ফোনে লাগাতে পারবেন না।

এজন্য মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া ডিভাইস কোন সমস্যা হলে সেটা খুঁজে বের করতে বেগ পোহাতে হতে পারে কিছুটা। বিশেষ করে নেটওয়ার্কের সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে।

এখন ফোনে নেটওয়ার্ক না পেলে আপনি চাইলেই আপনার সিমকার্ডটি খুলে অন্য ফোনে তুলতে পারেন। এতে করে নিজেই বুঝতে পারেন সমস্যাটি নেটওয়ার্কের নাকি আপনার ফোনের। ই-সিমের ক্ষেত্রে সেরকম সুযোগ নেই। ডিভাইসের সমস্যা মানেই আপনাকে সার্ভিস সেন্টারে যেতে হবে।

এছাড়া নতুন প্রযুক্তি হিসেবে ই-সিম জনপ্রিয় হতে এবং পুরোপুরি মূলধারার প্রযুক্তিতে প্রবেশ করতে কিছুটা সময় লাগবে। এসময়ে যেমন এটা উন্নত হবে ধীরে ধীরে। তেমনি প্রযুক্তিগত না না ত্রুটিরও কবলে পড়তে হবে বর্তমান ব্যবহারকারীদের।

তবে যেহেতু অসুবিধার চেয়ে সুবিধার পাল্লাই এক্ষেত্রে ভারি। তাই, কিছুটা সময় গেলে আশা করা যায় ই-সিম এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে পুরোপুরিভাবে সিমকার্ডের জায়গা নিয়ে নেবে।

ই-সিম যেভাবে কাজ করে

ই-সিম নিয়ে এই ছিলো আজকের আলোচনা। আশা করি ই-সিম কী, এটা কীভাবে কাজ করে এবং ই-সিমের সুবিধা অসুবিধাগুলো বুঝতে পেরেছেন। ই-সিম নিয়ে এই লেখাটি আপনার ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। সেই সাথে ই-সিম বা এই লেখাটি নিয়ে কোন প্রশ্ন বা মতামত থাকলে জানিয়ে দিন আমাদের কমেন্ট বক্সে।


1 Comment

ছবির মাঝে থাকা টেক্সট কপি করার যতো উপায় - কেন্দ্রবাংলা · September 25, 2021 at 3:24 pm

[…] আরও পড়তে পারেনঃ ই-সিম কী? ই-সিম সম্পর্কে আপনার যা জানা দ… […]

  • Leave a Reply

    Avatar placeholder

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    2023 © KendroBangla | All Rights Reserved