ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে অপারেটিং সিস্টেম কথা উঠলেই আমরা বুঝি উইন্ডোজ বা ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমকে। গ্রাফিকাল ইন্টারফেস, প্রচুর পরিমাণ সফটওয়্যার, মার্কেটিং আর ব্যবহার যে কারো জন্য সহজ হওয়াতে বিগত ধরে কয়েকদশক ব্যাবহারকারীর দিক থেকে শীর্ষে অবস্থান করছে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম। দামের কারণে তুলনামূলক কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও উইন্ডোজের পরেই অবস্থান অ্যাপলের ম্যাক ওএস এর। অথচ সম্পুর্ণ ফ্রি হওয়া সত্ত্বেও লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমগুলো সাধারণ ব্যবহারকারীর কাছে ততটা পৌঁছাতে পারে নি। প্রচারণার অভাব, লিনাক্স সম্পর্কে সাধারণ ব্যবহারকারীদের ভুল ধারণা এবং অজ্ঞতা এর অন্যতম একটা কারণ।

কেন লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম বেশিরভাগ মানুষ ব্যবহার করেন না, তা নিয়ে বিস্তারিত এখান থেকে দেখে আসতে পারেন। এই লেখায় আমরা লিনাক্স কেন অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেম থেকে এগিয়ে সেটা নিয়েই কথা বলবো। লিনাক্সের শত শত সুবিধার মধ্য থেকে ৫টি সুবিধার কথা এখানে আলোচনা করবো।

লিনাক্স কেন অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেম থেকে এগিয়ে

প্রসঙ্গত বলা রাখা ভালো যে, লিনাক্স ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ ব্যবহারকারীদের পুরোপুরি জয় করে নিতে না পারলেও পৃথিবীর বেশিরভাগ সুপার কম্পিউটার, স্মার্টফোন, স্মার্ট গ্যাজেট এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনও পরিচালিত হচ্ছে লিনাক্স ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে। লিনাক্স কী? তা নিয়ে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটি পড়ে ফেলতে পারেন।

কেন লিনাক্স ব্যবহার করবেন? এর ৫টি কারণ

যাইহোক, আর কথা না বাড়িয়ে চলুন লিনাক্স নিয়ে আজকের মূল আলোচনায় প্রবেশ করি। জানার চেষ্টা করি লিনাক্স কেন অন্যান্য অপারেটিং সিস্টেম থেকে এগিয়ে এবং কেন লিনাক্স ব্যবহার করবেন?

নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ

আপনি যদি আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন হন, তাহলে লিনাক্সের বিকল্প কোন কিছু হতে পারে না। যেখানে উইন্ডোজ বা ম্যাকওএস এর বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীর তথ্যচুরির অভিযোগ রয়েছে। সেখানে লিনাক্স আপনাকে সে দুশ্চিন্তা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে সক্ষম।

লিনাক্সের ডিস্ট্রোগুলো সাধারণত তৈরি হয় উদারমনা ডেভেলপারদের কল্যাণে। যেহেতু লিনাক্স একটি ফ্রি এবং উন্মুক্ত একটি কার্নেল। তাই এই ডিস্ট্রোগুলো কয়েকটা বাদে সবগুলোই ফ্রি এবং উন্মুক্ত। যার ফলে কেউ একটি লিনাক্স ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম বা ডিস্ট্রো তৈরি করলে অন্যরা সেটা যাচাই বাছাই করে দেখার সুযোগ পায়। ফোলে ক্ষতিকর কোন প্রোগ্রাম লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে দেওয়ার সুযোগ নেই।

যেমনটা করার সুযোগ রয়েছে উইন্ডোজ কিংবা ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমে। আপনি এসব অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে পারবেন কিন্তু এদের প্রত্যেকটি ফাইল কীভাবে কাজ করে, কী কাজ করে তা জানার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু লিনাক্সে চাইলেই আপনি অপারেটিং সিস্টেমের সব ফাইলের গতি প্রকৃতি, কাজ সবকিছু নিজে যাচাই করে দেখতে পারবেন।

লিনাক্সে আপনিই অপারেটিং সিস্টেমের সর্বোময় কর্তা। আপনার অনুমতি ছাড়া লিনাক্স ডিস্ট্রো কোন ফাইলে সিস্টেমে যোগ কিংবা পরিবর্তন করে না। যেটা কাজটা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম হরহামেশাই করে থাকে। ফলশ্রুতিতে উইন্ডোজ ইন্সটল করার পরপরই এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ইন্সটল করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তারপরও কম্পিউটারকে ভাইরাস মুক্ত রাখা সম্ভব হয় না বেশিরভাগ সময়। একটু অসতর্ক হলেই নানা রকম ম্যালওয়্যার, র‍্যানসমওয়্যারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

লিনাক্স এধরণের কোন ভয় নেই। যেহেতু আপনার অনুমতি ছাড়া কোন ফাইলই সিস্টেমে প্রবেশ করবে না বা পরিবর্তিত হবে না। তাই, যে কোন ধরণের ভাইরাসের ঝুঁকি থেকে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম থাকে প্রায় পুরোপুরি মুক্ত।

ফ্রি এবং ওপেন সোর্স

আগেই বলেছি লিনাক্স ফ্রি এবং ওপেনসোর্স। ফলে কম্পিউটারে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করতে চাইলে আপনাকে এক পয়সাও খরচ করতে হবে না। কিংবা পাইরেটেড সিডি বা প্যাচিং সফটওয়্যার ইন্সটল করে ব্যবহার করতে হবে না। যেকোন লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনের ওয়েবসাইটে গিয়েই তাদের অপারেটিং সিস্টেম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করে কম্পিউটারে ইন্সটল করতে পারবেন। শুধু যে অপারেটিং সিস্টেম ফ্রি তাই নয়, লিনাক্সের হাতেগোনা কিছু সফটওয়্যার বাদে সব সফটওয়্যারই ফ্রি।

ফ্রিতে যখন কম্পিউটারের জন্য নিরাপদ একটি অপারেটিং সিস্টেম আর সফটওয়্যার পাবেন, তখন কেন টাকা দিয়ে উইন্ডোজ কিনবেন? কিংবা অসাধু উপায়ে পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করবেন?

লিনাক্সের আরও একটি বর সুবিধা হচ্ছে, এটি ওপেন সোর্স। যার ফলে আপনি আপনার লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের যাবতীয় কাজকর্ম দেখতে পারবেন, বুঝতে পারবেন। এর সুবিধাটি উপরেই বলেছি। এছাড়া, ওপেনসোর্স হওয়ায় লিনাক্স কার্নেল ব্যবহার করে নিজের মতো করে অপারেটিং সিস্টেম তৈরির সুযোগ তো রয়েছেই।

ইউজার ইন্টারফেস

লিনাক্স সম্পর্কে সাধারণ ব্যবহারকীদের অনেকের মধ্য একটা ভুল ধারণা কাজ করে যে, লিনাক্স শুধুমাত্র কীবোর্ড থেকে কমান্ড দিয়ে চালাতে হয়। কথাটি এখন একেবারেই সত্য নয়। বর্তমানে সব লিনাক্স ডিস্ট্রোই গ্রাফিকাল ইন্টারফেস ব্যবহার করে। ফলে, উইন্ডোজ বা ম্যাকওএস এর মতই মাউস দিয়ে সবধরনের কাজ করে ফেলা যায় যে কোন লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে।

তবে আপনি যদি কম্পিউটারকে ভালোভাবে বুঝতে চান তাহলে টার্মিনাল নামের অসম্ভব সুন্দর একটি প্রোগ্রাম আপনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে লিনাক্সে। যেখানে কমান্ড লাইন লিখে কম্পিউটারের নাড়ি নক্ষত্র বের করে ফেলতে পারবেন। এবং কীবোর্ড দিয়েই পুরো কম্পিউটার অপারেট করতে পারবেন।

লিনাক্সের কিছু কিছু ডিস্ট্রিবিউশনের নজরকাড়া ইউজার ইন্টারফেস সত্যিই আপনাকে অবাক করবে। যেমন সহজ তেমনি দৃষ্টিনন্দন এসব ইউআই। তাই লিনাক্স ব্যবহার করা কঠিন এই ভ্রান্ত ধারণা মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন।

উইন্ডোজ বা ম্যাকওএস আদলেও রয়েছে লিনাক্সের অনেক ডিস্ট্রিবিউশনের ইউজার ইন্টারফেস। তাই আপনি যদি উইন্ডোজ কিংবা ম্যাকওএস এর সাথে পরিচিত হয়ে থাকেন, তাহলে লিনাক্সের ইউআই নিয়ে একদমই দুশ্চিন্তা কোন কারণ নেই।

কম্পিউটার শিক্ষার সঠিক হাতিয়ার লিনাক্স

যেহেতু লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম আপনাকে কম্পিউটারের সকল কাজকর্ম জানা এবং বোঝার সুযোগ করে দেয়, তাই কম্পিউটার সম্পর্কে শিখতে চাইলে লিনাক্সের বিকল্প নেই। বিশেষত, সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে। একটি অপারেটিং সিস্টেম কীভাবে কাজ করে, সফটওয়্যার কীভাবে কাজ করে এসব হাতে কলমে শেখার জন্য লিনাক্স আদর্শ।

কম্পিউটার সম্পর্কে জানার আগ্রহ না থাকলেও লিনাক্স আপনার বন্ধু হিসেবে কাজ করতে পারে। অনার্স লেভেলে বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টিতে পড়াশোনা প্রায় প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীরই প্রায় MathLab নামের একটি সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জন্য এই সফটওয়্যারটি দাম প্রায় আকাশছোঁয়া। লিনাক্সের এর বিকল্প হিসেবে Scilab বা GNU Octave ব্যবহার করতে পারবেন একদম ফ্রিতে।

এছাড়া, অ্যাট্রোনমির শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে Celestia কিংবা Stellarium, রসায়নের শিক্ষার্থীদের জন্য Avogadro কিংবা Gabedit, বায়োলজির শিক্ষার্থীদের জন্য EMBOSS বা TreeView X; পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে Octopus বা Step নামের চমৎকার সব সফটওয়্যার।

কমিউনিটি এবং সাপোর্ট

লিনাক্সের প্রতিটা ডিস্ট্রিবিউশনেরই রয়েছে শক্তিশালী এবং আন্তরিক সাপোর্ট কমিউনিটি। যেখানে শতশত ডেভেলপার এবং ইউজার তাদের মত বিনিময় ও সাহায্য করে থাকে। যেকোন সমস্যায় পড়লে আপনি এসব ফোরামে জানাতে পারেন। দ্রুততার সাথে সমাধান পেয়ে যাবেন। এজন্য কোন ব্লগ বা ইউটিউব ভিডিও দেখার প্রয়োজন নেই।

এই ছিল লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের সুবিধাগুলো নিয়ে আজকের আলোচনা। এর বাইরে লিনাক্সের আরও অনেক অনেক সুবিধা রয়েছে। লেখা সহজ ও সক্ষিপ্ত রাখতে গিয়ে সেসব বাদ দিতে হয়েছে। চেষ্টা করেছি টেকনিক্যাল বিষয় বাদ দিয়ে সাবলীল ভাষায় লিনাক্স কেন ব্যবহার করবেন, তার কারণগুলো তুলে ধরতে। লেখায় ভুলত্রুটি চোখে পড়লে কিংবা কোথাও বুঝতে অসুবিধা হলে অনুগ্রহপূর্বক আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন। লিনাক্স নিয়ে এই লেখা এই আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে নিতে ভুলবেন না।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved