বই মানুষকে আলোকিত করে, কল্পনা এবং চিন্তাশক্তিকে শাণিত করে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ভয়ংকর আগ্রাসন রুখে দিতে ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে পারে একমাত্র বই। বই পড়ে অন্যকে বই পড়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে আমাদের কেন্দ্রবাংলার বিশেষ আয়োজন, বই পরিচিতি।

বই পরিচিতি ঠিক বুক রিভিউ ধরণের লেখা নয়। বরং বই এর বিষয়বস্তু, বই নিয়ে পাঠকের খোলামেলা অনুভূতি নিয়ে কথা বলবো আমরা এখানে। যেখানে থাকবে না কোন নিয়ম কানুনের বালাই। বই পরিচিতি লেখার সময় যথাসম্ভব স্পয়লার এড়িয়ে যাবো আমরা। যদি কোন লেখায় স্পয়লার থাকে তবে সেটা শুরুতে বলে নিবো।

বই পরিচিতি আপনাদের কেমন লাগবে জানি না, কিন্এতু টুকু বলতে পারি, আমাদের প্রকাশিত কোন বই পরিচিতি পড়ে বইটি কেমন সম্পর্কে আশাকরি সঠিক তথ্য জানতে পারবেন। বইটির স্বাদ কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারবেন। তাহলে চলুন আর কথা না বাড়িয়ে বণী আদম বইটি নিয়ে আমাদের আজকের বই পরিচিতি শুরু করি।

বণী আদম – শওকত ওসমান

লেখক পরিচিতিঃ শওকত ওসমান

শওকত ওসমান আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। শওকত তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম; প্রকৃত নাম, শেখ আজিজুর রহমান। ১৯১৭ সালে ২ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে।

জীবদ্দশায় তিনি রচনা করেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, আত্মজীবনীসহ শতাধিক গ্রন্থ। এর মধ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, জননী (১৯৫৮), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), ওটেন সাহেবের বাংলো (১৯৪৪) ইত্যাদি।

কথাসাহিত্য অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৮৩) সহ আরও অনেক পুরষ্কার এবং সম্মাননা। গুণী এই কথাসাহিত্যিক, ১৯৯৮ সালের ১৪-ই মে পরলোকগমন করেন।

বণী আদম - শওকত ওসমান

বই পরিচিতিঃ বণী আদম

শওকত ওসমান রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্য বণী আদম খুব বেশি বিখ্যাত না হলেও এটি একটি সুখপাঠ্য উপন্যাস। লেখকের নিজস্ব রচনাশৈলী চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এতে। গল্প, চরিত্রায়ন, শব্দের ব্যবহার সবকিছুতেই রেখেছেন মুন্সিয়ানার সাক্ষর। চলুন এক নজরে বণী আদম বইটি সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

বইয়ের নামঃ বণী আদম
লেখকঃ শওকত ওসমান
ধরণঃ সামাজিক উপন্যাস
প্রথম প্রকাশঃ বইটি প্রথম কবে প্রকাশিত হয় সে সম্পর্কিত তথ্য আমরা খুঁজে পাই নি। তবে বর্তমানে বাজারে থাকা বণী আদম বইয়ের সংস্করণটি “সময় প্রকাশন” থেকে ২০০৯ সালে একুশে বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
মূল্যঃ ১৫০ টাকা

কাহিনী ও প্রেক্ষাপটঃ

ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে দাঙ্গা। ৩০ এর দশকে বাংলার গ্রামীণ কিংবা শহুরে সাধারণ মানুষদের জীবন খুব বেশি সুখকর নয়। এমনই এক পটভূমিতে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হারেস। বোকা সোকা, সহজ সরল প্রকৃতির এক গ্রাম্য যুবক। গ্রামের প্রতিপত্তিশীল জোতদার সলিম মুনশীর আশ্রয়ে যার বেড়ে ওঠা। লোহার মতো শরীর আর অভিযোগবিহীন আজ্ঞা পালনের প্রকৃতি তাকে যেন করে তুলেছিলো প্রভুভুক্ত এক যন্ত্রমানবে। দিনরাত রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিরলস খেটে যায় হারেস। বিনিময়ে জোটে দুমুঠো ভাত আর একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাই। এতোকিছুর পরও পান থেকে চুন খসলেই হারেসের উপর চলে নির্যাতন।

বোকাসোকা হারেসও তাই একদিন হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। হয়ে ওঠে যন্ত্রমানব থেকে রক্তমাংসের মানুষ। সলীম মুনশিকে বেইজ্জতিকে করে বলে ওঠে,

“পনর বছর আপনার গোলাম— গোলামের মত মেহনত করছি— তার কি কোন দাম নেই, বেতন নেই?”

এরপর মুক্ত পাখির মতো নিজেকে স্বাধীন করে হারেস বেরিয়ে পড়ে জীবনে পথে।

ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে একসময় হারেস থিতু হয় শহরে। শহরের কর্মমুখী নানারঙের জীবন আর জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই হারেসের চিন্তাবুদ্ধিকে পরিপক্ক করে তুলে। তবে তা সরলতা আর মাটির টান থেকে হারেসকে আলাদা করতে পারে না। মাটির কোলে বেড়ে ওঠা হারেস শহরের বদ্ধ ঘরে শুয়ে স্বপ্ন দেখে একজোড়া বলদ, একটুখানি চাষের জমি, নিজের একটি বসতভিটা একটি সংসারের।

এখানেই যেন হারেস অন্যসবার চেয়ে আলাদা। এই স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে চলে গল্প। মাঝে মাঝেই উপন্যাসে যুক্ত হয় নতুন চরিত্র। গল্প মোড় নেয় নতুন দিকে। দারিদ্রতা বিশেষ করে সেই সময়ে বাংলার সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের নিদারুণ এক অধ্যায় ফুটে উঠেছে গল্পে। ফুটে উঠেছে চিরকাল সুবিধাভোগী সমাজের উচুতলার মানুষের চিরচেনা রূপ। আছে মানবিকতা, মায়াময়তার এক স্নিগ্ধ প্রতিচ্ছবি।

পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই কখনো চোখ বেয়ে নামে অশ্রুধারা। কখনো আনন্দে কখনো বা কষ্টে। মানুষের জীবন তো এমনই। এই হাসি-কান্না, চড়াই উৎরাই নিয়েই মানুষের জীবন। সময়ের স্রোতধারা যে নিয়ম কখনো পাল্টাতে পারে না।

পাঠকের অনুভূতিঃ

উপন্যাসটি শুরুতে পড়তে একটু খাপছাড়া মনে হয়েছিলো আমার কাছে। পারিপার্শিকতার অতিরিক্ত বর্ণনা, উপমা আর অলংকারের জন্য একটু দুর্বোধ্যও মনে হয় মাঝে মাঝে। যারা ভারী ধরণের বই পড়ে অভ্যাস্ত নন, তাদের জন্য শুরুতে বইটি পড়া একটু কষ্টকর মনে হতে পারে।

কিন্তু গল্পে প্রবেশ করা মাত্রই সেই কষ্ট নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। উপভোগ করতে শুরু করবেন শওকত ওসমানে নিজস্ব গল্প বলার ঢঙ আর নানা অপ্রচলিত শব্দের এক অসাধারণ উপস্থাপনা। বইটিতে তীব্র অশালীন কোন সংলাপ বা ঘটনার বর্ণনা নেই। গল্পের প্রয়োজন কিছু উপন্যাসের অংশ অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য অনুপোযোগী মনে হতে পারে। ছোট কাউকে বইটি উপহার বা পড়তে বলার পূর্বে আপনি নিজে একবার পড়ে নিবেন।

বণী আদম - শওকত ওসমানঃ উক্তি

আগামীতে নানা ধরণের বই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রবাংলায় প্রকাশিত হবে বই পরিচিতি, ইনশাআল্লাহ্‌। বই নিয়ে আপনার মতামত, অনুভূতি; বিশেষকরে আজকের বণী আদম বইটি নিয়ে এই লেখাটি আপনার কাছে কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে আমাদের জনাতে ভুলবেন না। আপনার পড়া যে কোন বই সম্পর্কেও আমাদেরকে জানাতে পারেন। পরবর্তীতে আমরা সেই বইটি পড়ে বই পরিচিতি লেখার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ্‌।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved