রহস্য গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে? আর সেটা যদি হয় বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা অবলম্বনে তাহলে তো কথাই নেই। আজ সেরকম একটা গল্পই শুনবো আমরা। জানবো “দ্য লস্ট রোয়ানোক কলোনি” এর অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে।

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্যগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই ঘটনাকে। যেখানে একটি সম্পূর্ণ জনবসতি কোনো নিদর্শন ছাড়াই হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। কী ঘটেছিলো সেখানে? আসুন হারিয়ে যাই প্রায় ৪৫০ বছরের পুরোনো এক রহস্যের সাগরে।

হারানো রোয়ানোক কলোনি

দ্যা লস্ট রোয়ানোক কলোনি
ফিচার ছবি

ঘটনার সূত্রপাতঃ

৮ই মে, ১৫৮৭। আনুমানিক ১২০ জন উপনিবেশক ইংল্যান্ড থেকে তরী ছাড়লেন উত্তর আমেরিকার রোয়ানোক আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যা বর্তমানের নর্থ ক্যারোলিনা নামে পরিচিত। তারা জুলাই মাসের কোনো একসময়ে পৌছালো। এই অভিযানের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন জন হোয়াইট। যিনি একজন শিল্পী এবং অনুসন্ধানকারী হিসেবে পরিচিত।

প্রথম দিকে উত্তর আমেরিকার এই বাসিন্দাদের থেকে ছোট কিছু আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিলো। তাই উপনিবেশকরা চাচ্ছিলো জন হোয়াইট আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যাক এবং প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে ফিরে আসুক। যেমনঃ জনবল, খাদ্যসামগ্রী, হাতিয়ার ইত্যাদি।

তাই পরবর্তী মাসেই, অর্থাৎ আগস্ট ১৫৮৫ তে, ১১৫ জন উপনিবেশকে দ্বীপটিতে রেখে দিয়েই, জন হোয়াইট পুনরায় ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন। এই উপনিবেশকের মাঝে ছিলেন ৮৭ জন পুরুষ, ১৭ জন মহিলা, এবং ১১ জন শিশু। যার মাঝে স্বয়ং জন হোয়াইটের মেয়ে এলানোর হোয়াইট ডেয়ার ও ছিলো। যিনি গর্ভবতী ছিলেন, এবং সেখানে অবস্থানকালেই তিনি একটি কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ করেন, যার নাম দেওয়া হয়েছিলো ভার্জেনিয়া ডেয়ার। উত্তর আমেরিকান ইংরেজ উপনিবেশকদের মাঝে ইনিই প্রথম নবজাতক ছিলেন।

যাইহোক, আমরা আবার জন হোয়াইটে প্রসঙ্গে আসি। তিনি যখন ইংল্যান্ডে পৌছুলেন তখন ইংরেজরা সবেমাত্র স্পেনের সাথে যুদ্ধ করবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলো। তাই জন হোয়াইট ঘটনাচক্রে সেখান থেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক ফিরতে পারেননি। তিনি যখন আবার উত্তর আমেরিকার পথে পা বাড়ালেন, ততদিনে পার হয়ে গেলো তিনটে বছর।

রহস্যর শুরুঃ

অতঃপর তিনি যখন দ্বীপে পৌছুলেন তখন তিনি বিষ্ময়ের সহিত আবিষ্কার করলেন পুরো কলোনিটাই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেনো। তিনি দ্বীপময় খুঁজে বেড়িয়েও কোনো মৃত লাশ কিংবা কোনো মানুষের হাড়-হাড্ডি কিছুই দেখতে পাননি। শুধুমাত্র সেখানে একটা কাঠের গুড়িতে খোদাই করা একটি সাংকেতিক শব্দ ছাড়া। খোদাইকৃত শব্দটি ছিলো- “CROATOAN”।

জনশ্রুতি আছে জন হোয়াইট এরপর দক্ষিণ দিকে ৫০ মাইল দূরে বর্তমানে হেটারেস দ্বীপের উদ্দেশ্যে দুইবার যাত্রা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রতিবারই ঝড়ের কবলে ব্যর্থ হয়েছেন। পরবর্তীতে তৃতীয়বার চেষ্টা করবার মত প্রতিকুল অবস্থায় তার নৌ যানটি ছিলো না, তাই রিক্ত হস্তেই তিনি ইউরোপে ফিরে আসেন এবং ১৫৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়তে পারেনঃ দুর্বোধ্য ‘ভয়েনিচের পান্ডুলিপি’ : শত বছরের এক অমিমাংসিত রহস্য!

তবে কি ঘটেছিলো রোয়ানোক কলোনি বাসিন্দাদের সাথে?

কলোনির সেই ১১৫ জনের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা কেউ জানে নি। তবে এ নিয়ে অনেকগুলো মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন স্থানীয় আদিবাসীদের হাতেই সকলের প্রাণ যায়। কেউ ভাবেন প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের জন্যে হয়ত। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই অনুমান ভিত্তিক মতবাদগুলো সম্পর্কে।

প্রথম মতবাদঃ

উপনিবেশকরা স্থানীয় আদিবাসীদের হাতে মারা গিয়েছে। বস্তুত, ৮৫’ থেকে ৮৬’ এর পূর্ববর্তী সময়ে ইংরেজরা তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলো, কলোনিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যে। কিন্তু আদিবাসীদের দ্বারা পালটা আক্রমণ ও নিজেদের খাদ্য স্বল্পতার জন্যে তাদের ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে হয়।
এ সময় রোয়ানোকে কলোনি স্থাপনের জন্যে প্রথম নিযুক্ত গভর্নর ছিলেন রালফ লেইন। যিনি আদিবাসীদের নেতা উইঞ্জিনাকে মেরে ফেলতে নিয়েছিলেন, যাতে তারা উপনিবেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে।

আমরা ইতমধ্যেই জানি, পরবর্তীতে ১৫৮৭ সালে আবারো কিছু উপনিবেশিকের আগমন ঘটে ইংল্যান্ড থেকে।

তবে, এ মতবাদে কিছু অস্পষ্টতা এখনো রয়েই যায়। যদি সেই শ’খানেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে থাকে তাহলে কোথায় গেলো তাদের লাশগুলো? কোথাও কোনো মৃতের কঙ্কাল, মাথার খুলি কিছুই পাওয়া যায় নি।

দ্বিতীয় মতবাদঃ

এ মতবাদ অনুসারে, কলোনির ইংরেজরা স্থানীয় অন্য আরেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ আদিবাসীদের (ক্রোয়াটোয়ান) সাথে যোগদান করে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রতিনিধি হতে পারেন, ম্যানটিও নামে এক আদিবাসী। যিনি দুই দুইবার ইংল্যান্ড যাত্রা করেছিলেন প্রথমটি ১৫৮৪ সালে। জন হোয়াইটের সাথে সে একই জাহাজে করে ১৫৮৭ সালে রোয়ানেক কলোনি তে আসে। সেখানে কিছুদিন থাকে এবং ব্যপটিস্ট হয়ে যান। জন হোয়াইট তখন তাকে রোয়ানোক উপজাতির প্রধান ঘোষণা করেন। কিন্তু ম্যানটিও রোয়ানোকের আদিবাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ক্রোয়াটোনিয়ান। তাই তিনি রোয়ানোকের আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এবং নিজের দ্বীপে ফিরে গেলেন।

ধারণা করা হয় ম্যানটিও পরে আবার ফিরে আসে তার লোকবল নিয়ে এবং তখন তিনি ইংরেজ উপনিবেশিকদের কেও সাথে করে নিজের দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়, অষ্টাদশ, উনবিংশ এমনকি একবিংশ শতাব্দীতের বিভিন্ন সময় রহস্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিলো। ২০১৫ সালে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, ক্রোয়াটোয়ান দ্বীপে (বর্তমানে হেটারেস দ্বীপ নামে পরিচিত) ইউরোপিয়ান ব্যবহার্য কিছু নমুনা খুঁজে পান যার মাঝে ছিলো ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের ব্যবহার্য অস্ত্র সরঞ্জামের টুকরোবিশেষ, মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ভাঙা টুকরো, ফলকের উপর ইংরেজি বর্ণমালা, ইত্যাদি সহ বেশ কিছু জিনিস।

এই মতবাদ অনুসারে বলা যেতে পারে, খোদাইকৃত “CROATOAN” সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে তারা এটাই বুঝাতে চেয়েছিলো কলোনির পরবর্তী গন্তব্যস্থল কোথায় হতে যাচ্ছে।

কিন্তু এখানেও সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। উপরেই আমরা জানলাম জন হোয়াইট দুই দুইবার চেষ্টা করেও নতুন দ্বীপে পৌছুতে পারেননি। এবং পর্যায়ক্রমে ব্যর্থ হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন। তাহলে কেনো তিনি পরবর্তীতে নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না?

তৃতীয় মতবাদঃ

এ তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন, উপনিবেশিকরা রোয়ানোক দ্বীপ হতে ক্রোয়াটোয়ান দ্বীপে না গিয়ে সমুদ্র হতে দূরের কোনো লোকালয় কিংবা দেশাভ্যন্তরস্থ কোথাও ঠাঁই নিয়েছিলো।

পূর্বেই বলেছি, জন হোয়াইট একজন শিল্পীও ছিলেন তিনি ১৫৮৫ থেকে ১৫৯৩ পর্যন্ত জলরঙ এর সাহায্যে “La Virginia Pars” এই শিরোনামে একটি নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে ষোড়শ শতাব্দীতে যতগুলো নর্থ আমেরিকার মানচিত্রাঙ্কণ হয়েছিলো তার মাঝে এটি অন্যতম নিখুঁত ছিলো। এই মানচিত্রে রোয়ানোক এবং ক্রোয়াটোয়ান দুইটি স্থানই স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিলো।

আপাতদৃষ্টিতে মানচিত্রে তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখা না গেলেও সম্প্রতিকালে বেশ কিছু আধুনিক পরীক্ষার সাহায্যে ব্রিটিশ মিউজিয়াম মানচিত্রের মাঝে এক রহস্যময় চারকোনা তারকার সন্ধান পেয়েছেন। যা আরেকটি টুকরো কাগজ দিয়ে তালি আকারে গোপন অবস্থায় ছিলো। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা একটা দুর্গ সদৃশ কোনো স্থাপনা হবে। এবং মানচিত্র অনুসারে যা রোয়ানোক দ্বীপ থেকে আরো ভিতরে দেশাভ্যন্তরস্থ স্থানে অবস্থিত। ধারণা করা হয়, সেখানেই হয়ত আশ্রয় নিয়েছিলো ইংরেজ উপনিবেশকরা।

রহস্যময় চারকোনা তারকা
জন হোয়াইট জলরঙ এর সাহায্যে “La Virginia Pars” এই শিরোনামে একটি নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, তালি দেওয়া জায়গাটুকুতে দুর্গের এই চিত্র সাধারণ চোখে কখনোই বোধগম্য হবে না। কিন্ত সেখানে তাপ দিয়ে উত্তপ্ত করা হলে ফুটে উঠবে সেই দুর্গ সদৃশ প্রতিকৃতিটি। প্রশ্ন হচ্ছে জন হোয়াইট কেনো মানচিত্রে একবার দুর্গ আঁকবার পরেও তা গোপন করতে চেয়েছিলেন? তবে কি ইংরেজ সরকারকে রোয়ানোক কলোনি সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে তিনি কুণ্ঠিত বোধ করেছিলেন? আর তাই যদি হয় তবে কেন?

পরবর্তীতে সেই স্থানে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু পুরাতন ইউরোপীয় ব্যবহার্য বস্তুর সন্ধান মিলে। যা আরো সম্ভাবনা তৈরি করে, যে রোয়ানোকের সেই উপনিবেশকেরা দেশের অভ্যন্তরস্থ ওই দুর্গ সদৃশ এলাকাতেই হয়ত ঠাঁই নিয়েছিলো।

আরও পড়তে পারেনঃ পেরিস্কোপ : একটি সাধারণ কিন্তু বিস্ময়কর আবিষ্কার

কিন্তু এরপরেও অনেক প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না। কেনো কলোনির লোকের রোয়ানোক দ্বীপ ছাড়লো? পরবর্তীতে তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো? এছাড়া কেনো কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ যাচ্ছিলো না এত বছর পরেও? তবে কি কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা?

চতুর্থ মতবাদঃ

অনেকে মনে করেন রোয়ানোকের সেই উপনিবেশিকদের ভিনগ্রহীরা জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। এবং মানচিত্রের সেই গুপ্ত চারকোনা তারকা সংকেতটি কোনো দুর্গ না হয়ে কোনো ভিনগ্রহী আকাশযান ও হতে পারে। তবে এ মতবাদ ততোটা গ্রহণযোগ্য হয় নি।

এছাড়াও আরেকটি ধারণা মতে, ধারণা করা হয়, সেই দ্বীপে হয়ত কোনো ভয়ানক ভাইরাস কিংবা জম্বি আক্রমণ হয়েছিলো। মানুষখেকো এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলো দ্বীপের উপনিবেশিকরা। কিন্তু এখানেও কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই।

সবশেষে, ঠিক কি হয়েছিলো সেই রেখে যাওয়া মানুষদের ভাগ্যে তা আজও অজানা। অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষেও কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসমাপ্তিতে পৌছুতে পারেনি কেউই।

ধন্যবাদ পুরোটা পড়বার জন্যে। রোয়ানোক কলোনি সম্পর্কে জেনে আপনার কেমন লেগেছে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। এবং এই রহস্যপূর্ণ ঘটনাটি পরিবার ও বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করবেন।


মোঃ মারুফ আহমেদ

বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে বিষয়ে স্নাতক করছি। ভালো মানুষ হবার প্রচন্ড ইচ্ছে বুকে নিয়েই অনাগত পৃথিবীতে নিজের যাত্রা অব্যাহত রেখেছি।

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved