প্রায় সব মানুষই নতুন বছরের শুরুতে নিজেকে নতুনভাবে গুছিয়ে নিতে চান। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রায় ডজনখানেক অভ্যাস রয়েছে। এসব অভ্যাসের কিছু যেমন ভালো, তেমনি কিছু থাকে যা ক্ষতিকর। ক্ষতিকর বা বদ অভ্যাস ত্যাগ করার একটা সংকল্প বছরের শুরুতে সবার মাঝেই কাজ করে।

কিন্তু কোন অভ্যাস ত্যাগ করা কি খুব সহজ? নাকি খুব কঠিন? কথায় বলে, মানুষ অভ্যাসের দাস। আসলেই কি তাই? নাকি অভ্যাসই আসলে মানুষের দাস?

আমরা অনেকেই তুমুল আগ্রহ নিয়ে নতুন বছরে খারাপ অভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করি। কিন্তু দুয়েকদিন না যেতেই হতাশা বা অলসতা কাজ করে। কোন অগ্রগতিই হচ্ছে না। আমার দ্বারা এসব সম্ভব না। এরকম নানা চিন্তা মনে আসে।

অভ্যাস ত্যাগ করতে কতোটা সময় প্রয়োজন?

অভ্যাস ত্যাগ করতে কতোটা সময় লাগে?

কোন কিছুতে অভ্যাস্ত হওয়া কি খুব সহজ?

আপনাকে কোন অভ্যাস ত্যাগ করতে সাহায্য করবে, এরকম প্রচুর অ্যাপ রয়েছে বর্তমানে। যার মধ্য অনেকগুলোতেই আবার বলা হয় যে, অভ্যাস ছাড়তে আপনার প্রয়োজন মাত্র ২১ দিন সময়ের।

২১ দিন এই সময়টি এসেছে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত জনপ্রিয় বই সাইকো-সাইবারনেটিকস থেকে। যে বইটি লিখেন ম্যাক্সওয়েল মল্টজ্‌ নামের এক ভদ্রলোক। যিনি পেশায় ছিলেন একজন প্লাস্টিক সার্জন। তিনি তার পেশাগত জীবনে লক্ষ করেন একজন রোগী প্লাস্টিক সার্জারির পর তার নতুন চেহারায় অভ্যাস্ত হতে প্রায় ২১ দিন সময় নেন।

যাইহোক, ২০০৯ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী একটি অভ্যাস তৈরী হতে বা ছাড়তে কতোটা সময় লাগবে তা আসলে এতোটা পরিষ্কার করে বলা যায় না। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একদল গবেষক ১২ সপ্তাহ ধরে ৯৬ জন মানুষের অভ্যাস পরীক্ষা করে দেখেছেন। যে ফলাফল পেয়েছেন সেটা হলো, নতুন কোন অভ্যাস তৈরী করতে গড়ে তাদের সময় লেগেছে ৬৬ দিন করে। তবে ব্যাক্তিভেদে অভ্যাস গঠনের সময়ের মধ্য ছিলো বিশাল ব্যবধান। কেউ যেখানে মাত্র ১৮ দিনে নতুন কোন অভ্যাস গঠন করতে পেরেছেন সেখানে অন্যকেউ সময় নিয়েছেন ২৫৪ দিন।

আরও পড়তে পারেনঃ ইন্টারনেট নিয়ে ১০টি অবাক তথ্য, আপনার জানা আছে কি?

সবমিলিয়ে এতোটুকু বলা যায় আপনি যদি নতুন কোন অভ্যাস তৈরী করতে চান তাহলে অন্তত দুইমাস সময় হাতে নিয়ে চেষ্টা করলে সফলতা পেতে পারেন। এর মাঝে কোনভাবেই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে। ব্যাক্তিভেদে যেহেতু এটা প্রায় সাড়ে আটমাস পর্যন্তও সময় লাগতে পারে, তাই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়াটা মোটেই কোন কাজের কাজ হবে না। লেগে থাকুন এই সময়টা একসময় সেটা অবশ্যই অভ্যাসে পরিণত হবে।

অভ্যাস ত্যাগ করতে কতোটা সময় লাগে?

এতো গেল অভ্যাস তৈরী করা নিয়ে কথা। আমাদের আলোচনা তো আসলে অভ্যাস ছাড়া নিয়ে। এবার তাহলে চলুন জানার চেষ্টা করি, মোটামুটি কতোদিন সময় লাগতে পারে একটি বাজে অভ্যাস ছাড়তে?

অভ্যাস ছাড়ার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অভ্যাস তৈরী বিষয়ে আলোচনা করলাম এই কারণে যে, বিষয় দুইটি আসলে বেশ ভালোভাবে কানেক্টেড। মনোবিজ্ঞানী টিমোথি পাইচিল বিষয়টি নিয়ে এলিসন নাস্তাসির কাছে ব্যাখ্যা করে বলেন, “যে কোন অভ্যাস ছাড়ার অর্থ হচ্ছে নতুন কোন অভ্যাস তৈরি করা। যখন কোন অভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্ক থেকে কিন্তু ঐ অভ্যাসের বিষয়টা মুছে ফেলা যায় না। মস্তিষ্কের যে অংশ অভ্যাসটা নিয়ে কাজ করতো সেটা আসলে তখনও একই অবস্থায় থাকে। ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করলেও ঐ অংশটা সক্রিয় থাকে। তবে যেহেতু ছেড়ে দেওয়ার একটা ইচ্ছাশক্তি মস্তিষ্কেই তৈরী হয়, তাই ঐ অংশটা আগের চেয়ে তুলনামূলক কম সক্রিয় হয়ে যায়।”

স্নায়ুবিজ্ঞানী এলিয়ট বার্কম্যান এ বিষয়ে বলেন, “আমরা যে অভ্যাসটি ছেড়ে দিতে চাচ্ছি সেটার জায়গায় যদি নতুন কোন অভ্যাস গঠন না করি; তাহলে অভ্যাস ছাড়াটা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর থেকে সম্পূর্ণ নতুন কোন অভ্যাস তৈরী করাও অনেক করা সহজ।”

আরও পড়তে পারেনঃ বণী আদম – জীবন সংগ্রামের এক নিদারুণ গল্প

এ ক্ষেত্রে সব বিশেষজ্ঞই একটা ব্যাপারে একমত যে, অভ্যাস ছেড়ে দেওয়ার ধরাবাঁধা কোন ফর্মুলা নেই। একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, চারপাশের অবস্থা, ব্যক্তিত্ব সবকিছু যেহেতু অন্য মানুষের থেকে আলাদা হয়; তাই অভ্যাস ছেড়ে পদ্ধতি এবং সময়ও সবার ক্ষেত্রে একদম একই রকম হয় না।

বার্কম্যান বলেন, “যারা তাদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারণে তাদের বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে চায়, তারা সামজিক চিন্তার কারণে বদ অভ্যাস ত্যাগ চাওয়া মানুষদের চেয়ে দ্রুত সফলতা পান।” অর্থাৎ বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে হলে সবার আগে আপনার ভিতর থেকে সেটা ঘৃণা করতে হবে।

বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি আর ধৈর্য্য

বাহ্যিক প্রভাব বদ-অভ্যাস দূর করতে দারুণ সাহায্য করে

মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুসান ক্রাউস হুইটবোর্নের মতে, বাহ্যিক প্রভাবেও কখনও কখনও একটি অভ্যাস দ্রুত ত্যাগ করা যায়। “এক্ষেত্রে আকস্মিক বা চরম পরিস্থিতি উদ্ভব হওয়া প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যারা ধূপমান করেন তারা যদি প্রতিবার ধূমপান করার সময় বাঁধাপ্রাপ্ত হন অথবা শারীরিক কষ্ট অনুভব করেন তাহলে দ্রুত ধুমপান এর অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। চলতি পথে ফোন ব্যবহার করার অভ্যাস আছে এমন কেউ যদি চলার সময় হোঁচট খেতে থাকেন তাহলে অল্প সময়ের মধ্যই ফোনের আসক্তি কমিয়ে ফেলতে পারবেন।”

এগুলো তো সবসময় সবার সাথে ঘটে না। তাই, স্বাভাবিকভাবে একটি অভ্যাস ত্যাগ করতে কমপক্ষে দুইমাস সময় হাতে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

এক্ষেত্রে নতুন বদ অভ্যাস ত্যাগ করে সেখানে নতুন অভ্যাস গড়ে তোলাটা আপনাকে দারুনভাবে সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে নতুন যে অভ্যাস গড়ে তুলবেন অবশ্যই সেটা ভালো অভ্যাস হওয়া চাই। অতিরিক্ত ঘুয়াম্নোর অভ্যাস দূর করতে আপনি যদি অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন সেটা নিশ্চয়ই কোন কাজের কাজ হবে না।

গড়তে যতোটা সময়, ত্যাগ করতে যতোটা সময়

বদ অভ্যাস দূর করতে আপনাকে প্রচন্ড ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখবেন যে বদ অভ্যাসটা আপনি যতো বেশিদিন ধরে চর্চা করছেন সেটা ছাড়তেও আপনার তত দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে যেতে হবে। এর মধ্য কোন ফাঁকি দেওয়া যাবে না।

বার্কম্যান বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “দীর্ঘদিনের অভ্যাস অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তির মতো হয়ে যায়। মস্তিষ্কে প্রায় স্থায়ী আসন গেড়ে বসে। যেটা থেকে বের হয়ে আসা খুবই কষ্টসাধ্য হতে পারে। তবে অসম্ভব নয়। মানুষ সবসময়ই ইচ্ছাশক্তি নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। আর আমাদের জীবনে এতো ভালো কিছু করার আছে যে, খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে সুন্দর অভ্যাস তৈরি করার বিষয়ের কোন অভাব হয় না।”

তাই আপনি যদি আপনার বদ-অভ্যাস ত্যাগ করতে চান। তাহলে এখন থেকেই সেটাকে নিজের ভিতর থেকে ঘৃণা করুন। সমাজ বা অন্য কারো জন্য নয়। বরং সেই বদ-অভ্যাসের কারণে আপনার কী কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা লিখে ফোনের ওয়ালপেপারে সেট করে রাখুন। নিজের জন্যই সেটাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিন। অন্তত দুইমাস সময় ধৈর্য্য ধরে নিজেকে সেটা থেকে বিরত রাখুন। এবং ঐ বদ-অভ্যাসের পরিবর্তে একটা সুন্দর অভ্যাস গড়ে তুলুন। সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ্‌।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2023 © KendroBangla | All Rights Reserved